রমজান আলী মামুন
চৈত্রের ঝলমলে বিকেল। চারিদিকে ডালিম-আতা আর তালগাছের ঘনছায়া। সাঁই-সাঁই করে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। এমন সময় স্কুল থেকে ফিরে এসে একা একা চার দেয়ালে আটকা পড়ে থাকতে ভীষণ কষ্ট হয় টিপুর। কিন্তু কি করবে? আব্বু কোথাও যেতে বারণ করে দিয়েছেন। শহড়ের অবস্থা নাকি বিশেষ ভালো না। গেটের বাইরে বের হলেই ছেলেধরারা ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যায়। আর এখানকার ছেলে ছোকরারাও ভীষণ ভয়ঙ্কর। ওরা নাকি রীতিমত ছোরা নিয়ে খেলা করে। আর কাউকে বাগে পেলে কুংফু-কারাতে মেরে সব ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এসব কথা ভাবতেই ভয়ে টিপুর শরীর কাটা দিয়ে উঠে। কিছুই ভাল্লাগে না তার। শিশু পার্ক, প্রশস্ত রাজপথ, বড় বড় দালান এখন তার কাছে পানসে মনে হয়। কিছুতেই শহড়টাকে আপনভাবতে পারে না সে। অথচ গত চার বপছর ধরে ওরা এখানে বাস করছে।
বিকেল পেরিয়ে যখন ফুটফুটে অন্ধকার চারিপাশটাকে অক্টোপাসের মত ঘিরে ধরে ঠিক তখনিই শহরের বুক চিরে নিয়ন বাতির আলোর দ্যুতি চৌরাস্তার মোড় থেকে অনেকটা পশ্চিমদিকে বাঁক নেয়া এই সরু গলিটিতে লুটিয়ে পড়ে। এক দৃষ্টিতে অসীম আকাশের দিকে চেয়ে থাকে টিপু। কতো শত তারকারাজির মধ্যে আলোর টোপর পড়ে হাসছে চাঁদটা। সে চাঁদে নাকি একটা বুড়ি দিনরাত্রি বসে বসে সূতা কাটে। ইস একবার যদি দেখতে পারতো টিপু। ভাবতেই পুলক অনুভব করে সে। দেখতে দেখতে অনেক রাত হয়ে যায়, খেয়াল থাকে না টিপুর।
‘ভাইজান আপনে এইহানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখতাছেন? আম্মাজান আপনারে যে পাগলের লাহান খোঁজতাছে। রাতনিশিতে বাইরে থাহন ভালা না। এইবার ঘরে আহেন।’
বুয়ার কথায় তন্ময়তা ভেঙ্গে যায় টিপুর।
‘আম্মু আমাকে ডাকছে?’
‘হু-ভাইজান, আম্মাজান আপনারে আমার লগে আইতে কইছে।’
‘বুয়া তুমি যাও আমি আসছি।’
ঘরে এসেই অনুযোগের সূরে টিপু আম্মুর কাছে যানতে চায়,
‘আচ্ছা আম্মু, আব্বু আর চাচু আমাদেরকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যায় না কেন?’
‘ওমা! ছেলের কথা শোন, সেখানে গিয়ে তুই কি করবি?’
‘কেনো কাজল আর মন্টুদের নিয়ে খেলবো। গুলতি ছুঁড়ে পাখি মারবো। আর চাচ্চুকে নিয়ে পুকুরে মাছ ধরবো। জানো আম্মু আমাদের পুকুরে না বড় বড় মাছ আছে। কাজল বলেছে ও পাড়ার ছেলেরা নাকি রাত্রে ছিপ দিয়ে মাছ তুলে নিয়ে যায়। এবার গেলে সব মাছ তুলে নিয়ে আসবো।’
‘কিন্তু তোর চাচ্চু গেলেইতো?’
‘কেনো যাবে না? ও বুঝেছি, চাচ্চুও আব্বুর মত শহরে থাকতে ভালবাসে তাই না আম্মু?’
‘হু-তাইতো।’
‘তবে কেন মিছিমিছি বলে সে আমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসে না?’
‘বারে তোকেইত বেশি ভালবাসে।’’
‘তবে যে বললে – ।’’
হঠাৎ কোত্থেকে ছুটে এসে শিলু আপু ফোঁড়ন কেটে উঠে। “আম্মু টিপুটার মাথায় না সব গোবর পোরা। একটুও মগজ নেই।”
আর যায় কোথায়, শিলু আপার কথায় টিপুতো রেগেই অস্থির। ভেংচি কেটে বলে, ‘তুমি জান কচু, তোমার মাথায় তো-।’’
আম্মু তাড়াতাড়ি শিলু আপুকে সাঁশিয়ে দেয়।
প্রতিদিন সকালে চা-নাস্তা সেরে টিপু আপুর সাথে স্বকুলে যায়। শিলু আপা ওকে স্কুল গেটে নামিয়ে দিয়ে একই রিকশায় দ্রুত কলেজে চলে যায়। শিলু, আম্মু, আব্বু আর চাচু ওরা সবাই সকাল বেলার নাস্তা খেতে টেবিলে বসে আছে। ওদিকে টিপুর আসার কোন নাম গন্ধটি নেই। ব্যাপার কি? আব্বু টিপু টিপু বলে কয়েকবার ডাকলেন, কিন্তু টিপুর কোন সাড়া পেলেন না। শেষমেষ তিনি শিলুকে বললেন, দেখতো মা, টিপুটা এতক্ষণ করছেটা কি? এদিকে স্কুলে যাবার যে সময় হয়ে এলো। শিলু চুপি চুপি ওর রুমে গিয়ে দেখে টিপু দিব্যি জামা কাপড় পড়ে জানালার ধারে বসে বেলিফুলের গাছটার দিকে আনমনে চেয়ে আছে।
‘বাঃ বাঃ ওদিকে নাস্তা করার জন্য আব্বু ডাকতে ডাকতে গলা শুকিয়ে ফেলছেন আর এদিকে আমাদের কবি সাহেব কিনা উদাস হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। বলি কি স্কুলে যাবার সময় হয়নি বুঝি?’
‘না, আমি তোমার সাথে স্কুলে যাবো না।’
‘তো কবি সাহেব কার সাথে যাবেন শুনি?’
আর যায় কোথায়, শিলু আপুর কথা শুনে টিপু রেগেমেগে ছুটে এসে আপুর চুলের মুঠি ধরে দেয় হেচকা টান।
‘আব্বু আব্বু আমাকে বাঁচাও! টিপু আমাকে মারছে।
আব্বু ছুটে আসে টিপুর রুমের দিকে, এসে দেখেন টিপু পেছন থেকে শিলুর চুল টেনে ধরেছে।
‘আব্বু, ওকে ছেড়ে দাও! ও-না তোমার আপু! আপুকে কি কেউ মারে?’
‘না আমি ছাড়বো না। আপু আমাকে শুধু শুধু খোচা দেয় কেনো?’
ও তোমাকে আর রাগাবে না। চুল ছেড়ে দাও। লোকে দেখলে কি বলবে?
টিপু চুল ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কি বলবে, আব্বু?’
‘বলবে, টিপু খুব দুষ্টু ছেলে, সে বড়দের গায়ে হাত তোলে। কিন্তু, আমরাতো জানি তুমি কত ভালো ছেলে, তাই না আব্বু!’
টিপু মাথা নাড়ে।
‘তাহলে আর কখনো আপুর চুল ধরে টানাটানি কোরো না কেমন! এবার খেতে এসো।’
টিপু আস্তে আস্তে খাবার টেবিলে এসে বসে। নাস্তা নাস্তা খেতে খেতে একবার ওর চোখ শিলু আপুর চোখের উপর পড়ে, ও লজ্জা পেয়ে যায়। সে দ্রুত নাস্তা খেয়ে রুমে চলে যায়।
‘আম্মু দেখলেতো টিপু আমার কতগুলো চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে।’
‘ভালই তো, তুই ওকে ক্ষেপাস কেন?’
‘ক্ষেপালাম কৈ? কবি বলেই ডাকতেই-।’
‘তোর কবি বলে ডাকবার কি দরকার ছিল? তাইতো ও ক্ষেপেছে।’
‘বারে কালকে বুয়া বললো যে আম্মাজান আমাগো ছোড সাব কবির লাহান সাত আসমান কিডা জানি খুঁজতাচ্ছে। মনে অয় কবিতা টবিতা লেখপো।’
শিলুর কথা বলার ডং দেখে সবাই হেসে ফেললো।
‘আসলে তুই খুব ফাজিল হয়েছিস, আর তাইতো টিপু তোর সাথে সব সময় রাগারাগি করে।’
‘আম্মু তুমিও এই কথা বলছো? যাও তোমার টিপু মনিকে আমি আর স্কুলে নিয়ে যেতে পারবো না। টিপুর সাথে আমার আড়ি।’
‘মেয়ের কথা শোন, ও যাবেটা কার সাথে?’
চাচু তখন বলে উঠে,
‘ঠিক আছে ভাবী ও না নিক, আমিই টিপুকে স্কুলে নিয়ে যাবো।’
দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে এসে টিপু কাঁধের ব্যাগটা ছুঁড়ে মেরে দ্রুত আম্মুর কাছে যেয়ে বলে,
‘আম্মু আমার বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে। খেতে দাও।’
‘ঠিক আছে, তুই হাত মুখ ধুয়ে আয়, বাবা, আমি বুয়াকে বলছি টেবিলে ভাত দিতে।’
ভাত খেতে খেতে টিপু বলে উঠে,
‘আম্মু তুমি চাচুকে নিষেধ করতো আমাকে যেনো আব্বু, আব্বু না করে।’
‘কেনো কি হয়েছে?’
‘কিচ্ছু হয়নি। চাচু আমার ছেলে হতে যাবে কেন? আমি কি বুড়ো?’
‘কে বললো তুই বুড়ো? তুইতো আমার ছোট্ট খোকন সোনা, তাইনা আব্বু?’
‘ফের তুমিও আব্বু আব্বু করছো? আমার লজ্জা করে না বুঝি?’
‘বারে ছেলেকে বুঝি আব্বু ডাকতে নেই?’
‘না আমাকে আব্বু ডাকবে না। টিপু ডাকবে।’
‘আচ্ছা বাবা, তাই হবে!’
হু-মনে থাকে যেন।’ টিপু গম্ভীর হয়ে বলে।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে, ও বিছানায় শুতে যায়। তারপর শুয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আম্মু আপু কোথায়।’
‘কেনরে? ওতো ওর রুমে শুয়েই আছে। গায়ে নাকি জ্বর। তাই আজ কলেজে যায়নি। দেখে আয় তো, তোর আপু কি করছে।’
আপুর জ্বর হয়েছে শুনে টিপুর মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে আপুর রুমের দিকে ছুটে যায় সে। ঘরের দরজার কাছে এসে সে হঠাৎ করে পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে আলতো করে দরজাটা ঠেলে ঘরের ভেতর ঢুকতে গিয়ে টিপুর বুকটা কেন যেন ডিপ ডিপ করে উঠে।
ও দেখে ওর আপু চুপ চুপ করে চিতারহস্য নামে একটা বই পড়ছিল। হঠাৎ ওকে ঘরে ঢুকতে দেখে চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নাক মুখ ঢেকে ফেলে।
‘আপু আমি আর তোমার সাথে মারামারি করবো না। এই তোমার গা ছুঁয়ে বলছি। আপু তুমি আমাকে মাফ করে দাও।’ বলতে বলতে টিপু কেঁদে ফেলে। শিলু বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে টিপুকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তুইতো আমার লক্ষি সোনা ভাই। তুই কেন মাফ চাইবি? দোষতো আমারই। শুধুশুধু তোকে রাগিয়ে দিই। এমা, ছিঃ ছিঃ কাঁদছিস কেন?’ শিলু হাত দিয়ে ওর চোখ দুটো মুছে দেয়।
‘কাঁদবো না! তুমি যে আমার সাথে আড়ি দিয়েছ।’
‘কে বলেছে আমি আড়ি দিয়েছি? আড়ি দিলে কি তোর সাথে কথা বলতুম?’
‘ও, তাহলে আমাকে স্কুলে নিয়ে গেলে না কেন?’
‘ভাইয়ার সাথে একটু অভিমান করলাম যে তাই!’
‘কেন আপু, তুমি আমার সাথে এরকম করো?’
‘বাঃ নইলে যে তুই তোর আপুকে কত্তখানি ভালোবাসিস তা জানবো কেমনে।’
‘আপু তুমি আসলে একটা-!’
‘আমি একটা কি?’
‘ইয়ে মানে-।’
‘ইয়ে মানেটা আবার কি?’
‘ইয়ে মানে তোমার বিয়ে। আব্বুকে বলবো তোমাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিতে।’
‘কি বললি, আমাকে তাড়াতাড়ি ভাগিয়ে দিতে চাস? দাঁড়া তোকে-।’
বলতেই টিপু ভোঁ দৌড়ে আপুর রুম থেকে পালিয়ে যায়।
শিশু কিশোর মাসিক পত্রিকা নবারূণ থেকে সংগৃহিত
বৈশাখ ১৩৯৬, এপ্রিল ১৯৮৯
ঈদ সংখ্যা।
No comments:
Post a Comment