হোসাইন মোবারক
ক’দিন ধরেই মনটা ভালো নেই। আজ বাদে কাল ওর রুনু আপুর বিয়ে। আপুর বিয়ে হয়ে গেলে অভিকে আর কেউই আদর করবে না। ওকে ছোট্ট রেখেই আম্মু মারা যায়, রুনি আপুই কোনদিন ওকে আম্মুর অভাব বুঝতে দেননি। আপু চলে গেলে কিভাবে অভির দিন কাটবে? বাসায় কথা বলবার মত একটি লোকও নেই, এক আব্বু ছাড়া। সেও আবার সকালে চলে যায় অফিসে আসে সেই রাত করে। আর আব্বুর সঙ্গেতো আর আপুর মত করে কথা বলা যাবে না। আব্বুতো আব্বুই। ভাবতেই অভির খুব কান্না আসে।
দু’দিন ধরে রুনু আপু অভিকে আর আগের মত ডাক দেয় না। কেন যেন দূরে দূরে থাকে। অভির খুব একটা খোঁজ নেয় না। সারাদিন বান্ধবীদের নিয়ে মেতে থাকে। এইতো ক’দিন আগেও তো অভির সঙ্গে এমনটি করতো না। ওর কেন যেন আপুকে পর পর লাগে।
বিয়ে বাড়ি। সমস্ত বাড়ি আলোতে ভরপুর। হৈ চৈ মাতামাতি। খুব জোরে বিদেশী গান বাজছে ডেক সেটে। সবাই আনন্দ করছে। অভি চুপ চাপ ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে একা। আর ভাবছে বিকেল করে আর আপুর সাথে পার্কে ঘোরা, আইসক্রিম খাওয়া আরো কত কি করা আর হবে না। আজ রাত পেরুলেই কাল বিয়ে, ভাবতেই ওর খারাপ লাগছে। সবচেয়ে প্রিয় আপু চলে যাবে শ্বশুর বাড়ি। ওর কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
আপু চলে গেলে অভিকে আর কেউ নিজের হাতে খাইয়ে দিবে না। স্কুলে না গেলে বকবে না, কোথাও না বলে গেলে শাসন করবে না, এমনকি স্কুলে যাওয়ার সময় চুলটি পর্যন্ত আঁচড়িয়ে দিবে না।
নীচে এতোক্ষণে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়ে গেছে। এক সময় ওর চাচাতো ভাই পিকলু এসে নীচে নিয়ে যেতে চায়, কিন্তু ও যায় না। একা ছাদে থাকতেই ভালো লাগে। আস্তে আস্তে অনেক রাত হয়ে আসে। একদিক থেকে ফুরফুরে বাতাস বইতে থাকে। কোথাও কোন সারা শব্দ নেই একমাত্র ওদের বাড়িছাড়া। সমস্ত শহর যেন ওর দুঃখ বুঝতে পেরে চুপ মেরে আছে।
যখন সকাল হয়, তখন কেউ বাবুর্চি নিয়ে, কেউ আবার ডেকোরেটরের জিনিসপত্র নিয়ে ব্যস্ত। ছোটরা এদিক ওদিক ঘুরা ফেরা করছে। গ্রামের বাড়ি থেকে আত্মীয়-স্বজন আসতে থাকে। বাড়ি গিজগিজ করতে থাকে লোকে। এত মানুষ অভির ভালো লাগেনা। আর তাই ও তনুদের বাড়ী গিয়ে সময় কাটায়। তনু ওর স্কুলের বন্ধু।
বর একটায় আসার কথা কিন্তু আসে সেই তিনটায়। ওর সঙ্গীরা সবাই গেটে আটকিয়ে রাখে বরকে ফিতে কাটার জন্য। তারপর অনেকক্ষণ ধরে কথা কাটাকাটি দু’পক্ষের মধ্যেই। অভি তাতে যোগ দেয় না। একটু পরেই খাওয়া-দাওয়ার ধুম পরে। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে রুনু আপুকে মেয়েরা মিলে সাজ-গোছ করায়। বউ বেশে আপুকে খুব সুন্দর দেখায়।
বিদায় দেয়ার সময় অভিকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদে আপু। আপুর মেকআপ নষ্ট হয়ে যায় চোখের পানিতে। অভি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ফুলে সাজানো গাড়িটার দিকে। যখন যান্ত্রিক আওয়াজ করে গাড়িটা ওর আপুকে নিয়ে চলে যায়, তখন ওর মনে হয় কে যেন দানবের মত ওকে আপুর আদর থেকে বঞ্চিত করল।
নবারূণ
এপ্রিল ১৯৮৯ বৈশাখ ১৩৯৬
ত্রয়োদশ বর্ষ ১০ম সংখ্যা থেকে গৃহীত।
No comments:
Post a Comment