জীবনানন্দ দাশের কবিতা - iqbal's blog

জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯, বরিশাল - মৃত্যু: ২২ অক্টোবর, ১৯৫৪, বঙ্গাব্দ: ৬ ফাল্গুন, ১৩০৫ - ৫ কার্তিক, ১৩৬১) বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে যখন তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতে পরিণত হয়েছেন। তিনি প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। তবে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে অকাল মৃত্যুর আগে তিনি নিভৃতে ১৪টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা গ্রন্থ করেছেন যার একটিও তিনি জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি। তাঁর জীবন কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধকাল অনপনেয়ভাবে বাংলা কবিতায় তাঁর প্রভাব মুদ্রিত হয়েছে। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসাবে তিনি সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃত।

(১) একদিন খুঁজেছিনু যারে-

 একদিন খুঁজেছিনু যারে

বকের পাখার ভিড়ে বাদলের গোধূলি-আঁধারে,

মালতীলতার বনে, –কদমের তলে,

নিঝুম ঘুমের ঘাটে, –কেয়াফুল, –শেফালীর দলে!

-যাহারে খুঁজিয়াছিনু মাঠে মাঠে শরতের ভোরে

হেমন্তের হিমঘাসে যাহারে খুঁজিয়াছিনু ঝরঝর

কামিনীর ব্যাথার শিয়রে,

যার লাগি ছুটে গেছি নির্দয় মসুদ, চীনা তাতারের দলে,

আর্ত কোলাহলে

তুলিয়াছি দিকে দিকে ব্যাথা বিঘ্ন ভয়,

আজ মনে হয়

পৃথিবীর সাঁজদীপে তার হাতে কোনদিন জ্বলে নাই শিখা!

-শুধু শেষ-নিশীথের ছায়া-কুহেলিকা,

শুধু মেরু আকাশের নীহারিকা, তারা

দিয়ে যায় যেন সেই পলাতকা চকিতার সাড়া!

মাঠে ঘাটে কিশোরীর কাঁকণের রাগিণীতে তার সুর

শোনে নাই কেউ,

গাগরীর কোলে তার উথলিয়া ওঠে নাই আমাদের

গাঙিনীর ঢেউ!

নামে নাই সাবধানী পাড়াগাঁর বাঁকাপথে চুপে চুপে

ঘোমটার ঘুমটুকু চুমি’!

মনে হয় শুধু আমি, –আর শুধু তুমি

আর ঐ আকাশের পউষ-নীরবতা

রাত্রীর নির্জনযাত্রী তারকার কানে-কানে কতকাল

কহিয়াছি আধো-আধো কথা।

-আজ বুঝি ভুলেগেছে প্রিয়া!

পাতাঝরা আঁধারের মুসাফের-হিয়া

একদিন ছিল তব গোধূলির সহচর, –ভুলেগেছ তুমি!

এ মাটির ছলনার সুরাপাত্র অনিবার চুমি

আজ মোর বুকে বাজে শুধু খেদ, –শুধু অবসাদ!

মহুয়ার, –ধুতুরার স্বাদ

জীবনের পেয়ালার ফোঁটা ফোঁটা ধরি

দুরন্ত শোণিতে মোর বারবার নিয়েছি যে ভরি’!

মসজেদ-সরাই-শরাব

ফুরায় না তৃষা মোর, –জুড়ায় না কলিজার তাপ!

দিকে দিকে ভাদরের ভিজা মাঠ, –আলেয়ার শিখা!

পদে পদে নাচে ফণা,-

পথে পথে কালো যবনিকা!

কাতর ক্রন্দন,-

কামনার কবর-বন্ধন!

কাফনের অভিযান, –অঙ্গার-সমাধি!

মৃত্যুর সুমেরু-সিন্ধু অন্ধকারে বারবার উঠিতেছে কাঁদি’!

মরমরকেঁদে ওঠে ঝরাপাতাভরা ভোররাতের পবন,-

আধো আঁধারের দেশ

বারবার আসে ভেসে

কার সুর!-

কোন সুদূরের তরে হৃদয়ের প্রেতপুরে ডাকিনীর মত মোর কেঁদে মরে মন!

 

 

(২) অস্তচাঁদে

 ভালোবাসিয়াছি আমি অস্তচাঁদ, –ক্লান্ত শেষপ্রহরের শশী!

-অঘোর ঘুমের ঘোরে ঢলে যাবে কালোনদী, –ঢেউয়ের কলসী,

নিঝঝুম বিছানার পরে

মেঘবৌর খোঁপাখসা জ্যোৎস্নাফুল চুপে চুপে ঝরে,-

চেয়ে থাকি চোখ তুলে’ –যেন মোর পলাতকা প্রিয়া

মেঘের ঘোমটা তুলে’ –প্রেত-চাঁদে সচকিত ওঠে শিহরিয়া!

সে যেন দেখেছে মোরে জন্মে-জন্মে ফিরেফিরেফিরে

মাঠে ঘাটে একা একা, –বুনো হাঁস জোনাকীর ভিড়ে!

দুশ্চর দেউলে কোন কোন যক্ষ-প্রাসাদের তটে,

দূর উর ব্যাবিলোন মিশরের মরুভু-সঙ্কটে,

কোথা পিরামিড তলে ঈসিসের বেদিকার মূলে,

কেউটের মত নীলা যেইখানে ফণা তুলেউঠিয়াছে ফুলে’,

কোন মন-ভুলানিয়া পথচাওয়া দুলালীর সনে

আমারে দেখেছে জ্যোৎস্না, –চোর চোখে অলসনয়নে!

 

 আমারে দেখেছে সে যে আসীরীয় সম্রাটের বেশে

প্রাসাদ-অলিন্দে যবে মহিমায় দাঁড়িয়েছি এসে’,-

হাতে তার হাত, পায়ে হাতিয়ার রাখি

কুমারীর পানে আমি তুলিয়াছি আনন্দের আরক্তিম আঁখি!

ভোরগেলাসের সুরা, –তহুরা, –রেছি মোরা চুপে চুপে পান,

চকোর জুড়ির মত কুহরিয়া গাহিয়াছি চাঁদিনীর গান!

পেয়ালায় পায়েলায় সেই নিশি হয়নি উতলা,

নীল নিচোলের কোলে নাচে নাই আকাশের তলা!

নটীরা ঘুমায়েছিল পুরে পুরে, ঘুমে রাজবধু, -

চুরি করে পেয়েছিনু ক্রীতদাসী বালিকার যৌবনের মধু।

সম্রাজ্ঞীর নির্দয় আঁখির দর্প বিদ্রূপ ভুলিয়া

কৃষ্ণাতিথি-চাঁদিনীর তলে আমি ষোরশীর উরু পরশিয়া

লভেছিনু উল্লাস, –উতরোল! আজ পড়ে মনে

সাধ-বিষাদের খেদ কত জন্মজন্মান্তরে, –রাতের নির্জনে!

 

 আমি ছিনু ত্রুবেদুরকোন দূর প্রভেনস’ –প্রান্তরে!

-দেউলিয়া পায়দল, –অগোচর মনচোর-যামিনীর তরে

সারেঙের সুর মোর এমনি উদাসরাত্রে উঠিত ঝঙ্কারি’!

আঙুরলতায় ঘেরা ঘুমঘোর ঘরখানা ছাড়িঁ

ঘুঘুর পাখনা মেলিমোর পানে আসিল পিয়ারা;

মেঘের ময়ুরপাখে জেগেছিল এলোমেলো তারা।

-অঁলিভ, –পাতার ফাঁকে চুণচোখে চেয়েছিল চাঁদ,

মিলননিশার শেষে বৃশ্চিক, –গোক্ষুরাফণা, –বিষের বিস্বাদ!

 

 স্পেইনের সিয়েরায় ছিনু আমি দস্যু-অশ্বারোহী,-

নির্মম-কৃতান্ত-কাল, তবু কি যে কাতর-বিরহী!

কোন রাজনন্দিনীর ঠোঁটে আমি এঁকেছিনু বর্বর চুম্বন!

অন্দরে পশিয়াছিনু অবেলার ঝড়ের মতন!

তখন রতনশেজে গিয়েছিল নিভেমধুরাতি!

নীল জানালার পাশে-ভাঙ্গাহাটে-চাঁদের বেসাতি!

চুপে চুপে মুখে কার পড়েছিনু ঝুঁকে’!

ব্যাধের মতন আমি টেনেছিনু বুকে

কোন ভীরু কপোতীর উড়ু উড়ু ডানা!

-কালো মেঘে কেঁদেছিল অস্তচাঁদ-আলোর মোহানা!

 

বাংলার মাঠে ঘাটে ফিরেছিনু বেণু হাতে একা,

গঙ্গার তীরে কবে কার সাথে হয়েছিল দেখা!

ফুলটি ফুটিলে চাঁদিনী উঠিলেএমনি রূপালি রাতে

কদমতলায় দাঁড়াতাম গিয়ে বাঁশের বাঁশিটি হাতে!

অপরাজিতার ঝাড়ে নদীপাড়ে কিশোরী লুকায়ে বুঝি’!-

মদনমোহন নয়ন আমার পেয়েছিল তারে খুঁজি’!

তারি লাগি বেঁধেছিনু বাঁকা চুলে ময়ুরপাখার চুড়া,

তাহারি লাগিয়া শুঁড়ি সেজেছিনু, –ঢেলে দিয়েছিনু সুরা!

তাহারি নধর অধর নিঙাড়িউথলিল বুকে মধু,

জোনাকীর সাথে ভেসে শেষরাতে দাঁড়াতাম দোরে বঁধু!

মনে পড়ে কি তা! চাঁদ জানে যাহা, –জানে যা কৃষ্ণাতিথির শশী,

বুকের আগুনে খুন চড়ে, –মুখ চুণ হয়ে যায় একেলা বসি’!


(৩) ছায়া-প্রিয়া

 

দুপুর রাতে ও কার আওয়াজ!

গান কে গাহে, –গান না!

কপোতবধু ঘুমিয়ে আছে

নিঝুম ঝিঁঝিঁর বুকের কাছে,

অস্তচাঁদের আলোর তলে

এ কার তবে কান্না!

গান কে গাহে, –গান না!

 

 

সার্সি ঘরের উঠছে বেজে,

উঠছে কেঁপে পর্দা।

বাতাস আজি ঘুমিয়ে আছে

জল-ডাহুকের বুকের কাছে,

এ কোন বাঁশী সার্সি বাজায়

এ কোন হাওয়া ফর্দা

দেয় কাঁপিয়ে পর্দা!

নুপুর কাহার বাজল রে ঐ!

কাঁকণ কাহার কাঁদল!

পরের বধু ঘুমিয়ে আছে

দুধের শিশুর বুকের কাছে;

ঘরে আমার ছায়া-প্রিয়া

মায়ার মিলন ফাঁদল!

কাঁকণ যে তার কাঁদল!

খসখসাল শাড়ী কাহার!

উসখুসাল চুল গো

পুরের বধু ঘুমিয়ে আছে

দুধের শিশুর বুকের কাছে;

জুলপি কাহার উঠলো দুলে’!

-দুল্ল কাহার দুল গো!

উসখুসাল চুল গো!

আজকে রাতে কে ঐ এল

কালের সাগর সাঁতরি!

জীবন-ভোরের সঙ্গিনী সেই,-

মাঠে ঘাটে আজকে সে নেই!

কোন তিয়াসায় এল রে হায়

মরণপারের যাত্রী!

-কালের সাগর সাঁতরি

কাঁদছে পাখী পউষ নিশির

তেপান্তরের বক্ষে!

 

ওর বিধবা বুকের মাঝে

যেন গো কার কাঁদন বাজে।

ঘুম নাহি আজ চাঁদের চোখে,

নিদ নাহি মোর চক্ষে!

তেপান্তরের বক্ষে!

এল আমার ছায়া-প্রিয়া,

কিশোর বেলার সই গো!

পুরের বধু ঘুমিয়ে আছে

দুধের শিশুর বুকের কাছে;

মনের মধু, –মনোরমা, -

কই গো সে মোর -কই গো!

কিশোর বেলার সই গো!


ও কার আওয়াজ হাওয়ায় বাজে!

গান কে গাহে, –গান না!

কপোতবধু ঘুমিয়ে আছে

বনের ছায়ায়, –মাঠের কাছে;

অস্তচাঁদের আলোর তলে

এ কার তবে কান্না!

গান কে গাহে, -গান না!

 

 

(৪) ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল

ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল,-

ডালিম ফুলের মতন ঠোঁট যার, –রাঙা আপেলের মত লাল যার গাল,

চুল যার শাঙনের মেঘ, –আর আঁখি গোধূলির মত, গোলাপী রঙীন,

আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে, –স্বপ্নে-কতদিন।

মোর জানালার পাশে তারে দেখিয়াছি রাতের দুপুরে,-

তখন শকুনবধূ যেতেছিল শ্মশানের পানে উড়ে, উড়ে!

মেঘের বুরুজ ভেঙেঅস্ত চাঁদ দিয়েছিল উঁকি,

সে কোন বালিকা একা অন্তঃপুরে এল অধোমুখী!

পাথারের পারে মোর প্রাসাদের আঙিনার পরে

 

দাঁড়াল সে, –বাসর রাত্রির বধূ, –মোর তরে, যেন মোর তরে

তখন নিভিয়া গেছে মণিদীপ, –চাঁদ শুধু খেলে লুকোচুরি,-

ঘুমের শিয়রে শুধু ফুটিতেছি-ঝরেতেছি ফুলঝরি, –স্বপনের কুঁড়ি!

অলস আঢুল হাওয়া জানালায় থেকে ফুঁপায় উদাসী!

কাতর নয়ন কার হাহাকারে চাঁদিনীতে জাগে গো উপাসী!

 

কিঙ্খাবে-গালিচা-খাটে রাজবধূ-ঝিয়ারীর বেশে

কভু সে দেয়নি দেখা-মোর তোরণের তলে দাঁড়াল সে এসে’!

দাঁড়াল সে হেঁট মুখে, –চোখ তার ভরে গেছে নিল অশ্রুজলে!

মীনকুমারীর মত কোন দূর সিন্ধুর অতলে

ঘুরেছে সে মোর লাগি’! –উড়েছে সে অসিমের সীমা!

অশ্রুর অঙ্গারে তার নিটোল ননীর গাল, –নরম লালিমা

জ্বলে গেছে, –নগ্ন হাত, –নাই শাঁখা, –হারায়েছে রুলি,

এলোমেলো কালো চুল খসে গেছে খোঁপা তার, –বেণী গেছে খুলি’!

সাপিনীর মত বাঁকা আঙুলে ফুটেছে তার কঙ্কালের রূপ,

ভেঙেছে নাকের ডাঁশা, –হিমস্তন, –হিম রোমকুপ!

আমি দেখিয়াছি তারে, ক্ষুধিত প্রেতের মত চুমিয়াছি আমি

তারি পেয়ালায় হায়! পৃথিবীর ঊষা ছেড়েআসিয়াছি নামি

কান্তারে; –ঘুমের ভিড়ে বাঁধিয়াছি দেউলিয়া বাউলের ঘর,

আমি দেখিয়াছি ছায়া, –শুনিয়াছি একাকিনী কুহকীর স্বর!

বুকে মোর, কোলে মোর-কঙ্কালের কাঁকালের চুমা!

-গঙ্গার তরঙ্গ কান্র গায়, –‘ঘুমা, –ঘুমা!

ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল,-

ডালিম ফুলের মত ঠোঁট যার, –আপেলের মত লাল যার গাল,

চুল যার শাঙনের মেঘ, আর আঁখি গোধূলির মত গোলাপী রঙিন;

আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে, –স্বপ্নে, –কতদিন!

 

(৫) নির্জন স্বাক্ষর

তুমি তা জান না কিছু, না জানিলে,-

আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে!

যখন করিয়া যাব হেমন্তের ঝড়ে,

পথের পাতার মত তুমিও তখন

আমার বুকেরপরে শুয়ে রবে?

অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন

সেদিন তোমার!

তোমার এ জীবনের ধার

ক্ষয়ে যাবে সেদিন সকল?


আমার বুকের পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল,

তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই!-

শুধু তার স্বাদ

তোমারে কি শান্তি দেবে!

আমি ঝরে যাব, তবু জীবন অগাধ

তোমারে রাখিবে ধরে সেইদিন পৃথিবীর পরে,-

আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে!

রেয়েছি সবুজ মাঠে-ঘাসে-

আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে;

জীবনের রঙ তবু ফলান কি হয়

এই সব ছুঁইয়ে ছেনে!-সে এক নিস্ময়

পৃথিবীতে নাই তাহা-আকাশেও নাই তার স্থল-

চেনে নাই তারে অই সমুদ্রের জল!

রাতে রাতে হেঁটে-হেঁটে নক্ষত্রের সনে

তারে আমি পাই নাই;- কোনো এক মানুষীর মনে

কোনো এক মানুষের তরে

যে-জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে!-

নক্ষত্রের চেয়ে আরো নিঃশব্দ আসনে

কোনো এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে!

 

একবার কথা কইয়ে দেশ আর দিকের দেবতা

ববা হয়ে পরে থাকে-ভুলে যায় কথা!

যে-আগুন উঠেছিল তাদের চোখের তলে জ্বলে

নিভে যায় ডুবে যায় তারা যায় স্থলে

নতুন আকাঙ্খা আসে চলে আসে নতুন সময়,-

পুরানো সে নক্ষত্রের দিন শেষ হয়,

নতুনেরা আসিতেছে বলে!-

আমার বুকের থেকে তবুও কি পরিয়াছে স্থলে

কোনো এক মানুষীর তরে

যেই প্রেম জ্বালায়েছি পুরোহিত হয়ে তার বুকের উপরে!

 

আমি সেই পুরোহিত সেই পুরোহিত!-

যে-নক্ষত্র মরে যায়, তাহার বুকের শীত

লাগিতেছে আমার শরীরে,-

যেই তারা জেগে আছে, তার দিকে ফিরে

তুমি আছ জেগে-

যে-আকাশ জ্বলিতেছে, তার মত মনের আবেগে

জেগে আছ;-

 

জানিয়াছ তুমি এক নিশ্চয়তা-হয়েছ নিশ্চয়!

হয়ে যায় আকাশের তলে কত আলো-কত আগুনের ক্ষয়;-

কতবার বর্তমান হয়ে গেছে ব্যথিত অতীত-

তবুও তোমার বুকে লাগে নাই শীত

যে-নক্ষত্র ঝরে যায় তার!

যে-পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস-আকাশ তোমার!

জীবনের স্বাদ লয়ে জেগে আছ তবুও মৃত্যুরা ব্যথা দিতে

পার তুমি’;

তোমার আকাশে তুমি উষ্ণ হয়ে আছ, তবুও-

বাহিরের আকাশের শীতে

নক্ষত্রের হইতেছে ক্ষয়,

নক্ষত্রের মতন হৃদয়

পড়িতেছে ঝরে-

ক্লান্ত হয়ে- শিশিরের মত শব্দ করে!

জান নাকো তুমি তার স্বাদ,

তোমারে নিতেছে ডেকে জীবন অবাধ,

জীবন অগাধ!

হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন-

পথের পাতার মত তুমিও তখন

আমার বুকের পরে শুয়ে রবে? –অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন

সেদিন তমার!

তমার আকাশ-আল-জীবনের ধার

ক্ষয়ে যাবে সেদিন সকল?

আমার বুকের, পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল

তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই! শুধু তার স্বাদ

তোমারে কি শান্তি দেবে!

আমি চলে যাব, –তবু জীবন অগাধ

আত্মারে রাখিবে ধরে সেই দিন পৃথিবীর পরে;-

আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে!


(৬) অনেক আকাশ

 

গানের সুরের মত বিকালের দিকের বাতাসে

 

পৃথিবীর পথ ছেড়ে-সন্ধ্যার মেঘের রঙ খুঁজে

 

হৃদয় ভাসিয়া যায়, –সেখানে সে কারে ভালোবাসে!-

 

পাখির মতন কেঁপে ডানা মেলে হিম চোখ বুজে

 

অধীর পাতার মত পৃথিবীর মাঠের সবুজে

 

উড়ে-উড়ে ঘর ছেড়ে কত দিকে গিয়েছে সে ভেসে,-

 

নীড়ের মতন বুকে একবার তার মুখ গুঁজে,

 

ঘুমাতে চেয়েছে, –তবু ব্যথা পেয়ে গেছে ফেঁসে,-

 

তখন ভোরের রোদে আকাশে মেঘের ঠোঁট উঠেছিল হেসে।

 

আলোর চুমায় এই পৃথিবীর হৃদয়ের জ্বর

 

মে যায়; –তাই নীল-আকাশের স্বাদ-সচ্ছলতা-

 

পুর্ণ করে দিয়ে যায় পৃথিবীর ক্ষুধিত গহ্বর;

 

মানুষের অন্তরের অবসাদ-মৃত্যুর জড়তা

 

সমুদ্র ভাঙিয়া যায়; –নক্ষত্রের সাথে কয় কথা

 

যখন নক্ষত্র তবু আকাশের অন্ধকার রাতে-

 

তখন হৃদয়ে জাগে নতুন যে এক অধীরতা,

 

তাই লয়ে সেই উষ্ণ-আকাশেরে চাই যে জড়াতে

 

গোধুলির মেঘে মেঘে, নক্ষত্রের মত রব নক্ষত্রের সাথে!

 

 

আমারে দিয়েছ তুমি হৃদয়ের যে এক ক্ষমতা

 

ওগো শক্তি, –তার বেগে পৃথিবীর পিপাসার ভার

 

বাধা পায়, জেনে লয় নক্ষত্রের মতন স্বচ্ছতা!

 

আমারে করেছ তুমি অসহিষ্ণু-ব্যর্থ-চমৎকার!

 

জীবনের পারে থেকে যে দেখেছে মৃত্যুর ওপার,

 

কবর খুলেছে মুখ বার-বার ইসারায়,

 

বীণার তারের মত পৃথিবীর আকাঙ্ক্ষার তার

 

তাহার আঘাত পেয়ে কেঁপে-কেঁপে ছিঁড়ে শুধু যায়!

 

একাকী মেঘের মত ভেসেছে সে বৈকালের আলোয়- সন্ধ্যা!

 

 

 

সে এসে পাখির মত স্থির হয়ে বাঁধে নাই নীড়,-

 

তাহার পাখাইয় শুধু লেগে আছে তীর-অস্থিরতা!

 

অধীর অন্তর তারে করিয়াছে অস্থির-অধীর!

 

তাহারি হৃদয় তারে দিয়েছে ব্যাধের মত ব্যথা!

 

একবার তাই নিল-আকাশের আলোর গাঢ়তা

 

তাহারে মুগ্ধ, অন্ধকার নক্ষত্র আবার

 

তাহারে নিয়েছে ডেকে, –জেনেছে সে এই চঞ্চলতা

 

জীবনের; –উড়ে-উড়ে দেখেছে সে মরণের পার

 

এই উদ্বেলতা লয়ে নিশীথের সমুদ্রের মত চমৎকার!

 

 

 

গোধুলির আলো লয়ে দুপুরে সে করিয়াছে খেলা,

 

স্বপ্ন দিয়ে দুই চোখ একা-একা রেখেছে সে ঢাকি;

 

আকাশে আঁধারে কেটে গিয়েছে যখন ভোর-বেলা

 

সবাই এসেছে পথে, –আসে নাই তবু সেই পাখি!-

 

নদীর কিনারে দূরে ডানা মেলে উড়েছে একাকী,

 

ছায়ার উপরে তার নিজের পাখার ছায়া ফেলে,

 

সাজায়েছে স্বপনের পরে তার হৃদয়ের ফাঁকি!

 

সুর্যের আলোর পরে নক্ষত্রের মত আলো-জ্বেলে

 

সন্ধ্যার আঁধার দিয়ে দিন তার ফেলেছে সে মুছে অবহেলে!

 

 

 

কেউ তারে দেখে নাই; –মানুষের পথ ছেরে দূরে

 

হাড়ের মতন শাখা ছায়ার মতন পাতা লয়ে

 

যেইখানে পৃথিবীর মানুষের মত ক্ষুব্ধ হয়ে

 

কথা কয়,- আকাঙ্ক্ষার আলোড়নে চলিতেছে বয়ে।

 

হেমন্তের নদী, –ঢেউ ক্ষুধিতের মত এক সুরে

 

হতাশ প্রাণের মত অন্ধকারে ফেলিছে নিঃশ্বাস,-

 

তাহাদের মত হয়ে তাহাদের সাথে গেছি রয়ে,

 

দূরে পড়ে পৃথিবীর ধূলা-মাটি-নদী-মাঠ-ঘাস,-

 

পৃথিবীর সিন্ধু দূরে, –আরো দূরে পৃথিবীর মেঘের আকাশ!

 

 

 

এখানে দেখেছি আমি জাগিয়াছ হে তুমি ক্ষমতা,

 

সুন্দর মুখের চেয়ে তুমি আরো ভীষণ, –সুন্দর!

 

ঝড়ের হাওয়ার চেয়ে আরো শক্তি-আরো ভীষণতা

 

আমারে দিয়েছে ভয়! এইখানে পাহাড়েরপর

 

তুমি এসে বসিয়াছ, –এইখানে অশান্ত সাগর

 

তোমারে এনেছে ডেকে; –হে ক্ষমতা, তোমার বেদনা

 

পাহাড়ের বনে-বনে তুলিতেছে বিদ্যুতের ফণা

 

তোমার স্ফলিঙ্গ আমি, ওগো শক্তি, –উল্লাসের মতন যন্ত্রণা

 

আমার সকল ইচ্ছা প্রার্থনার ভাষার মতন

 

প্রেমিকের হৃদয়ের গানের মতন কেঁপে উঠে

 

তোমারে প্রাণের কাছে একদিন পেয়েছে কখন!

 

সন্ধ্যার আলোর মত পশ্চিম মেঘের বুকে ফুটে,

 

আঁধার রাতের মত তারার আলোর দিকে ছুটে,

 

সিন্ধুর ঢেউয়ের মত ঝড়ের হাওয়ার কোলে জেগে

 

সব আকাঙ্ক্ষার বাঁধ একবার গেছে তার টুটে!

 

বিদ্যুতের পিছে-পিছে ছুটে গেছি বিদ্যুতের বেগে!

 

নক্ষত্রের মত আমি আকাশের নক্ষত্রের বুকে গেছি লেগে

 

যে-মুহূর্ত চলে গেছে, –জীবনের যেই দিনগুলি

 

ফুরায়ে গিয়েছে সব, –একবার আসে তারা ফিরে;

 

তোমার পায়ের চাপে তাদের করেছ তুমি ধূলি!

 

তোমার আঘাত দিয়ে তাদের গিয়েছ তুমি ছিঁড়ে!

 

হে ক্ষমতা, –মনের ব্যাথার মত তাদের শরীরে

 

নিমেষে-নিমেষে তুমি কতবার উঠেছিলে জেগে!

 

তারা সব চলে গেছে ভূতুড়ে পাতার মত ভিড়ে

 

উত্তর হাওয়ার মত তুমি আজো রহিয়াছ লেগে!

 

যে-সময় চলে গেছে তা-ও কাঁপে ক্ষমতার বিস্ময়ে-আবেগে!

 

 

 

তুমি কাজ করে যাও, ওগো শক্তি, তোমার মতন!

 

আমারে তোমার হাতে একাকী দিয়েছি আমি ছেড়ে;

 

বেদনা-উল্লাসে তাই সমুদ্রের মত ভরে মন!-

 

তাই কৌতুহল তাই ক্ষুধা এসে হৃদয়েরে ঘেরে,-

 

জোনাকির পথ ধরে তাই আকাশের নক্ষত্রেরে

 

দেখিতে চেয়েছি আমি, –নিরাশার কোলে বসে একা

 

চেয়েছি আশারে আমি, –বাঁধনের হাতে হেরে-হেরে

 

চাহিয়াছি আকাশের মত এক অগাধের দেখা!-

 

ভোরের মেঘের ঢেউয়ে মুছে দিয়ে রাতের মেঘের কালো রেখা!

 

 

 

আমি প্রণয়িনী, –তুমি হে অধীর, আমার প্রণয়ী!

 

আমার সকল প্রেম উঠেছে চোখের জলে ভেসে!-

 

প্রতিধ্বনির মত হে ধ্বনি, তোমার কথা কহি

 

কেঁপে উঠে হৃদয়ের সে যে কত আবেগ আবেশে!

 

সব ছেড়ে দিয়ে আমি তোমারে একাকী ভালোবেসে

 

তোমার ছায়ার মত ফিরিয়াছি তোমার পিছনে!

 

তবুও হারায় গেছ, –হঠাৎ কখন কাছে এসে

 

প্রেমিকের মত তুমি মিশেছ আমার মনে-মনে

 

বিদ্যুৎ জ্বালায়ে গেছ, –আগুন নিভায়ে গেছ হঠাৎ গোপনে।

 

কেন তুমি আস যাও হে অস্থির, হবে নাকি ধীর!

 

কোনদিন? –রৌদ্রে মতন তুমি সাগরের পরে

 

একবার দুইবার জ্বলে উঠে হতেছ অস্থির!-

 

তারপর, চলে যাও কোন দূরে পশ্চিমে-উত্তরে,-

 

সেখানে মেঘের মুখে চুমো খাও ঘুমের ভিতরে,

 

ইন্দ্র-ধনুকের মত তুমি সেইখানে উঠিতেছ জ্বলে,

 

চাঁদের আলোর মত একবার রাত্রির সাগরে

 

খেলা কর; – জ্যোৎস্না চলে যায়, –তবু তুমি যাও চলে

 

তার আগে; –যা বলেছ একবার, যাবে নাকি আবার তা বলে!

 

 

 

যা পেয়েছি একবার পাব নাকি আবার তা খুঁজে!

 

যেই রাত্রি যেই দিন একবার কয়ে গেল কথা

 

আমি চোখ বুজিবার আগে তারা গেল চোখ বুজে,

 

ক্ষীন হয়ে নিভে গেল সলিতার আলোর স্পষ্টতা!

 

ব্যাথার বুকের পরে আর এক ব্যথা-বিহ্বলতা

 

নেমে এল; –উল্লাস ফুরায়ে গেল নতুন উৎসবে;

 

আলো-অন্ধকার দিয়ে বুনিতেছি শুধু এই ব্যথা,-

 

দুলিতেছি এই ব্যথা-উল্লাসের সিন্ধুর বিপ্লবে!

 

সব শেষ হবে; – তবু আলোড়ন, – তা কি শেষ হবে!

 

 

 

সকল যেতেছে চলে, – সব যায় নিভে-মুছে-ভেসে-

 

যে-সুর থেমেছে তার স্মৃতি তবু জেগে র‍্য!

 

যে-নদী হারায়ে যায় অন্ধকারে-রাতে-নিরুদ্দেশে,

 

তাহার চঞ্চল জল স্তব্ধ হয়ে কাঁপায় হৃদয়!

 

যে-মুখ মিলায়ে যায় আবার ফিরিতে তারে হয়

 

গোপনে চোখের পরে, –ব্যাথিতের স্বপ্নের মতন!

 

ঘুমন্তের এই অশ্রু কোন পীড়া সে কোন বিস্ময়

 

জানায়ে দিতেছে এসে! রাত্রি-দিন আমাদের মন

 

বর্তমান অতীতের গুহা ধরে একা - একা ফিরিছে এমন!

 

 

 

আমরা মেঘের মত হঠাৎ চাঁদের বুকে এসে

 

অনেক গভীর রাতে একবার পৃথিবীর পানে

 

চেয়ে দেখি, আবার মেঘের মত চুপে-চুপে ভেসে

 

চলে যাই এক ক্ষীণ বাতাসের দুর্বল আহ্বানে

 

কোন দিকে পথ বেয়ে! আমাদের কেউ কি তা জানে।

 

ফ্যাকাশে মেঘের মত চাঁদের আকাশ পিছে রেখে

 

চলে যাই; –কোন এক রুগ্ন হাত আমাদের টানে?

 

পাখির মায়ের মত আমাদের নিতেছে সে ডেকে

 

আরো আকাশের দিকে, –অন্ধকারে, –অন্য কারো আকাশের থেকে!

 

 

 

একদিন বুজিবে কি চারিদিকে রাত্রির গহ্বর!-

 

নিবন্ত বাতির বুকে চুপে-চুপে যেমন আঁধার

 

চলে আসে, –ভালোবেসে নুয়ে তার চোখের উপর

 

চুমো খায়, –তারপর তারে কোলে টেনে নয় তার,-

 

মাথার সকল স্বপ্ন হৃদয়ের সকল সঞ্চার

 

একদিন সেই শূণ্য সেই শীত-নদীর উপরে

 

ফুরাবে কি? –দুলে-দুলে অন্ধকারে তবু ও আবার

 

আমার রক্তের ক্ষুধা নদীর ঢেউয়ের মত স্বরে

 

গান গাবে, –আকাশের পুরানো কে আত্মার মতন

 

জেগে আছি; –বাতাসের সাথে-সাথে আমি চলি ভেসে,

 

পাহাড়ে-হাওয়ার মত ফিরিতেছে এক-একা মন,

 

সিন্ধুর ঢেউয়ের মত দুপুরের সমুদ্রের শেষে

 

চলিতেছে; –কোন এক দূর দেশ কোন নিরুদ্দেশ

 

জন্ম তার হয়েছিল, –সেইখানে উঠিছে সে বেড়ে;

 

দেহের ছায়ার মত আমার মনের সাথে মেশে

 

কোন স্বপ্ন! এ আকাশ ছেড়ে দিয়ে কোন আকাশেরে

 

খুঁজে ফিরি! গুহার হাওয়ার মত বন্দী হয়ে মন তব ফেরে।

 

 

 

গাছের শাখার জালে এলোমেলো আঁধারের মত

 

হৃদয় খুঁজিছে পথ, ভেসে-ভেসে, –সে যে কারে চায়!

 

হিমের হাওয়ার হাত তার হাড় করিছে আহত,-

 

সে-ও কি শাখার মত-পাতার মতন ঝরে যায়!

 

বনের বুকের গান তার মত শব্দ করে গায়!

 

হৃদয়ের সুর তার সে যে কবে ফেলেছে হারায়ে!

 

অন্তরের আকাঙ্ক্ষারে স্বপনেরে বিদায় জানায়

 

জীবন-মৃত্যুর মাঝে চোখ বুজে একাকী দাঁড়ায়ে;

 

ঢেউয়ের ফেনার মত ক্লান্ত হয়ে মিশিবে কি সে-ঢেউয়ের গায়ে!

 

 

 

হয়তো সে মিশে গেছে, –তারে খুঁজে পাবে নাকো কেউ!

 

কেন যে সে এসেছিল পৃথিবীর কেহ কি তা জানে!

 

শীতের নদীর বুকে অস্থির হয়েছে যেই ঢেউ

 

শুনেছে সে উষ্ণ-গান সমুদ্রের জলের আহ্বানে!

 

বিদ্যুতের মত অল্প আয়ু তবু ছিল তার প্রাণে,

 

যে-ঝড় ফুরায়ে যায় তাহার মতন বেগ লয়ে

 

যে-প্রেম হয়েছে ক্ষুদ্ধ সেই ব্যর্থ প্রেমিকের গানে

 

মিলায়েছে গান তার, –তারপর চলে গেছে বয়ে।

 

সন্ধ্যার মেঘের রঙ কখন গিয়েছে তার অন্ধকার হয়ে!

 

 

 

তবুও নক্ষত্র এক জেগে আছে সে যে তারে ডাকে!

 

পৃথিবী চায়নি যারে, –মানুষ করেছে যারে ভয়

 

অনেক গভীর রাতে তারায়-তারায় মুখ ঢাকে

 

তবুও সে! কোনো এক নক্ষত্রের চোখে বিস্ময়

 

তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে একা জেগে রয়!

 

মানুষীর মত? কিম্বা আকাশের তারাটির মত,-

 

সেই দূর-প্রণয়িণী আমাদের পৃথিবী নয়!

 

তার দৃষ্টি-তাড়নায় করেছে যে আমারে ব্যাহত,-

 

ঘুমন্ত বাঘের বুকে বিষের বাণের মত বিষম সে-ক্ষত!

 

 

 

আলো আর অন্ধকারে তার ব্যথা-বিহ্বলতা লেগে,

 

তাহার বুকের রক্তে পৃথিবী হতেছে শুধু লাল!

 

মেঘের চিলের মত দুরন্ত চিতার মত বেগে

 

ছুটে যাই, –পিছে ছুটে আসিতেছে বৈকাল-সকাল

 

পৃথিবীর; –যেন কোন মায়াবীর নষ্ট-ইন্দ্রজাল

 

কাঁদিতেছে ছিঁড়ে গিয়ে! কেঁপে-কেঁপে পড়িতেছে ঝরে!

 

আরো কাছে আসিয়াছে তবু আজ, –আরো কাছে কাল

 

আসিব তবুও আমি; –দিন-রাত্রি রয় পিছে পড়ে,-

 

তারপর একদিন কুয়াশার মত সব বাধা যাবে সরে!

 

সিন্ধুর ঢেউয়ের তলে অন্ধকার রাতের মতন

 

হৃদয় উঠিতে আছে কোলাহলে কেঁপে বার-বার

 

কোথায় রয়েছে আলো জেনেছে তা, –বুঝেছে তা মন, -

 

চারিদিকে ঘিরে তারে রহিয়াছে যদিও আঁধার!

 

একদিন এই গুহা ব্যথা পেয়ে আহত হিয়ার

 

বাঁধন খুলিয়া-দেবে! অধীর ঢেউয়ের মত ছুটে

 

সেদিন সে খুঁজে লবে ঐ দূর নক্ষত্রের পার!

 

সমুদ্রের অন্ধকারে গহ্বরের ঘুম থেকে উঠে

 

দেখিবে জীবন তার খুলে গেছে পাখির ডিমের মত ফুটে!


 

(১২) বনলতা সেন

 

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,

 

সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে

 

অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে

 

সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;

 

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,

 

আমারে দুদন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।

 

 

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,

 

মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর

 

হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা

 

সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,

 

তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’

 

পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

 

 

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত

 

সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;

 

পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন

 

তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;

 

সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায়ে এ-জীবনের সব লেন দেন,

 

থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

(১৩) কুড়ি বছর পরে

 

আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি

 

আবার বছর কুড়ি পরে-

 

হয়তো ধানের ছড়ার পাশে

 

কার্তিকের মাসে-

 

তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে-তখন হলুদ নদী

 

নরম নরম হয় শর কাশ হোগলায়-মাঠের ভিতর!

 

 

অথবা নাইকো ধান ক্ষেত আর,

 

ব্যস্ততা নাইকো আর,

 

হাঁসের নীড়ের থেকে খড়

 

পাখির নীড়ের থেকে খড়

 

ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল!

 

 

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি, বছরের পার-

 

তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার!

 

হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে

 

সরু সরু কালো কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,

 

শিরীষের অথবা জামের,

 

ঝাউয়ের-আমের;

 

কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে!

 

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি, বছরের পার-

 

তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!

 

তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে-

 

বাবলার গলির অন্ধকারে

 

অশথের জানালার ফাঁকে

 

কোথায় লুকায় আপনাকে!

 

চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে-

 

সোনালি সোনালি চিল-শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে-

 

কুড়ি বছর পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে!


 

(১৪) হাওয়ার রাত

 

গভীর হাওয়ার রাত ছিল কাল -  অসংখ্য নক্ষত্রের রাত,

সারা রাত বিস্তীর্ণ হাওয়া আমার মশারিতে খেলেছে;

মশারিটা ফুলে উঠেছে কখনো মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মত,

কখনো বিছানা ছীঁড়ে

নক্ষত্রের দিকে উড়ে যেতে চেয়েছে;

এক-একবার মনে হচ্ছিল আমার – আধো ঘুমের ভিতর হয়তো –

মাথার উপরে মশারি নেই আমার,

স্বাতী তারার কোল ঘেঁষে নীল হাওয়ার সমুদ্রে শাদা বকের মত উড়ছে সে

কাল এমন চমৎকার রাত ছিল।

 

সমস্ত মৃত নক্ষত্রেরা কাল জেগে উঠেছিল – আকাশে একতিল ফাঁক ছিল না;

পৃথিবীর সমস্ত ধূসর প্রিয় মৃতদের মুখও সেই নক্ষত্রের ভিতর দেখেছি আমি;

অন্ধকার রাতে অশ্বত্থের চূড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির – ভেজা চোখের

মত ঝলমল করছিল সমস্ত নক্ষত্রেরা;

জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রাণীর ঘাড়ের উপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার

শালের মত জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ!

কাল এমন আশ্চর্য রাত ছিল।

 

যে নক্ষত্রেরা আকাশের বুকে হাজার হাজার বছর আগে মরে গিয়েছে

তারাও কাল জানালার ভিতর দিয়ে অসংখ্য মৃত আকাশ সঙ্গে করে এনেছে;

যে রূপসীদের আমি এশিয়ারিয়ার, মিশরে, বিদিশায় মরে যেতে দেখেছি

কাল তারা অতিদূরে আকাশের সীমানার কুয়াশায় কুয়াশায় দীর্ঘ বর্শা হাতে

করে কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে যেন –

মৃত্যুকে সলিত করবার জন্য?

জীবনের গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য?

প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য?

আড়ষ্ট – অভিভূত হয়ে গেছি আমি,

কাল রাতের প্রবল নীল অত্যাচার আমাকে ছিঁড়ে ফেলেছে যেন,

আকাশের বিরামহীন বিস্তীর্ণ ডানার ভিতর

পৃথিবী কীটের মতো মুছে গিয়েছে কাল!

আর উত্তুঙ্গ বাতাস এসেছে আকাশের বুক থেকে নেমে

আমার জানালার ভিতর দিয়ে শাঁই শাঁই করে,

সিংহের হুঙ্কারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের অজস্র জেব্রার মতো!

হৃদয় ভরে গিয়েছে আমার বিস্তীর্ণ ফেল্টের সবুজ ঘাসের গন্ধে,

দিগন্ত – প্লাবিত বলীয়ান রৌদ্রের আঘ্রাণে

মিলনোন্মুক্ত বাঘিনীর গর্জনের মতো অন্ধকারের চঞ্চল বিরাট সজীব

রোমশ উচ্ছ্বাসে,

জীবনের দূর্দান্ত নীল মত্ততায়!

আমার হৃদয় পৃথিবী ছিঁড়ে উড়ে গেল,

নীল হাওয়ার সমুদ্রে স্ফীত মাতাল বেলুনের মত গেল উড়ে,

একতা দূর নক্ষত্রের মাস্তুলকে তারায় তারায় উড়িয়ে নিয়ে চলল

একটা দুরন্ত শকুনের মতো।


 

(২১) আমাকে তুমি

 

আমাকে

 

তুমি দেখিয়াছিলে একদিন

 

মস্ত বড় ময়দান দেবদারু পামের নিবিড় মাথা মাইলের পর মাইল;

 

দুপুরবেলার জনবিরল গভীর বাতাস

 

দূর শূণ্যে চিলের পাটকিলে ডানার ভিতর অস্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যায়;

 

জোয়ারের মতো ফিরে আসে আবার;

 

জানালায় জানালায় অনেকক্ষণ ধরে কথা বলেঃ

 

পৃথিবীর মায়াবীর নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়।

 

তারপর

 

 

 

 

দূরে

 

অনেক দূরে

 

খররৌদ্রে পা ছড়িয়ে বর্ষীয়সী রূপসীর মতো ধান ভানে গান গায়

 

                                                                                            গান গায়

 

এই দুপুরের বাতাস।

 

এক একটা দুপুরে এক একটা পরিপূর্ণ জীবন অতিবাহিত হয়ে যায় যেন।

 

বিকেলে নরম মুহূর্ত,

 

নদীর জলের ভিতর সম্বর, নীল্গাই, হরিণের ছায়ার আসা-যাওয়া;

 

একটা ধবল চিতল-হরিণীর ছায়া

 

আতার ধূসর ক্ষীরে গড়া মূর্তীর-মতো

 

নদীর জলে

 

সমস্ত বিকেলবেলা ধরে

 

স্থির।

 

 

 

মাঝে মাঝে অনেক দূর থেকে শ্মশানের চন্দনকাঠের চিতার গন্ধ,

 

আগুনের-ঘিয়ের ঘ্রাণ;

 

বিকেলে

 

অসম্ভব বিষন্নতা।

 

ঝাউ হরিতকী শাল, নিভন্ত সূর্যে

 

পিয়াশাল পিয়াল আমলকী দেবদারু-

 

বাতাসের বুকে স্পৃহা, উৎসাহ জীবনের ফেনা;

 

শাদা শাদাছিট কালো পায়রার ওড়াউড়ি জ্যোৎস্নায়-ছায়ায়,

 

রাত্রি;

 

নক্ষত্র ও নক্ষত্রের

 

অতীত নিস্তব্ধতা।

 

মরণের পরপারে বড় অন্ধকার

 

এই সব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো।

(২২) তুমি

 

 

নক্ষত্রের চলাফেরা ঈশারায় চারিদিকে উজ্জ্বল আকাশ;

 

বাতাসে নীলাভ হয়ে আসে যেন প্রান্তরের ঘাস

 

কাঁচপোকা ঘুমিয়েছে গঙ্গা ফড়িং সে-ও ঘুমে;

 

আম নিম হিজলের ব্যাপ্তিতে পড়ে আছ তুমি।

 

 

মাটির অনেক নিচে চলে গেছ? কিংবা দূর আকাশের পারে

 

তুমি আজ? কোন কথা ভাবছ আঁধারে?

 

ঐ যে ওখানে পায়রা একা ডাকে জামিরের বনেঃ

 

মনে হয় তুমি যেন ঐ পাখি তুমি ছাড়া সময়ের এ-উদ্ভাবনে

 

 

আমার এমন কাছে আশ্বিনের এত বড় অকূল আকাশে

 

আর কাকে পাব এই সহজ গভীর অনায়াসে-

 

বলতেই নিখিলের অন্ধকার দরকারে পাখি গেল উড়ে

 

প্রকৃতিস্থ প্রকৃতির মতো শব্দে প্রেম অপ্রেম থেকে দূরে।

(২৩) সুচেতনা

 

সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ

 

বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;

 

সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে

 

নির্জনতা আছে।

 

এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা

 

সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।

 

কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;

 

তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।

 

 

আজকে অনেক রূঢ় রৌদ্রে ঘুরে প্রাণ

 

পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মত

 

ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু,

 

দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত

 

ভাই বোন বন্ধু পরিজন পড়ে আছে;

 

পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;

 

মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।

 

 

 

কেবলি জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে

 

দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়;

 

সেই শস্য অগণন, মানুষের শব;

 

শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়

 

আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুশিয়সের মতো আমাদেরো প্রাণ

 

মূক করে রাখে; তবু চারিদিকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান!

 

 

 

সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে এ পথেই ক্রমমুক্তি হবে;

 

সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ;

 

এ বাতাস কি পরম সূর্যকরোজ্জ্বল;-

 

প্রায় তত দূর ভালো মানব-সমাজ

 

আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে

 

গড়ে দেব, আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।

 

মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি,

 

না এলেই ভালো হত অনুভব করে;

 

এসে যে গভীরতর লাভ হল সে সব বুঝেছি

 

শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে;

 

দেখেছি যা হল হবে মানুষেরা যা হবার নয়-

 

শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়!

(২৪) অঘ্রাণ প্রান্তরে

জানি আমি তোমার দু চোখ আজ আমাকে খোঁজে না

আর পৃথিবীর পরে-

বলে চুপে থামলাম, কেবলি অশত্থপাতা পড়ে আছে ঘাসের ভিতরে

শুকনো মিয়োনো ছেঁড়া; –অঘ্রাণ এসেছে আজ পৃথিবীর বনে;

সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে

হেমন্ত এসেছে তবু; বললে সে, ‘ঘাসের ওপরে সব বিছানো পাতার

মুখে এই নিস্তব্ধতা কেমন যে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার

ছড়িয়ে পড়েছে জলে’; –কিছুক্ষণ অঘ্রাণের অস্পষ্ট জগতে

হাঁটলাম, চিল উড়ে চলে গেছে-কুয়াশার প্রান্তরের পথে

দু একটা সজারুর আসা যাওয়া; উচ্ছল কলার ঝাড়ে উড়ে

চুপে সন্ধ্যার বাতাসে

লক্ষ্মীপেঁচা হিজলের ফাঁক দিয়ে বাবলার আধাঁর গলিতে নেমে আসে;

আমাদের জীবনের অনেক অতীত ব্যপ্তি আজো যেন

লেগে আছে বহতা পাখায়

ঐ সব পাখীদের; ঐ সব দূর দূর ধানক্ষেতে, ছাতকুড়োমাখা

ক্লান্ত জামের শাখায়;

নীলচে ঘাসের ফুলে ফড়িঙের হৃদয়ের মতো নীরবতা

ছড়িয়ে রয়েছে এই প্রান্তরের বুকে আজ হেঁটে চলি আজ কোনো কথা

নেই আর আমাদের; মাঠের কিনারে ঢের ঝরা ঝাউফল

পড়ে আছে; শান্ত হাত, চোখে তার বিকেলের মতন অতল

কিছু আছে; খড়কুটো উড়ে এসে লেগে আছে শাড়ির ভিতরে,

সজনে পাতার গুঁড়ি চুলে বেধে গিয়ে নড়ে চড়ে,

পতঙ্গ পালক জল চারিদিকে সুর্যের উজ্জ্বলতা নাশ;

আলেয়ার মত ঐ ধানগুলো নড়ে শূন্যে কি রকম অবাধ আকাশ

হয়ে যায়; সময়ও অপার তাকে প্রেম আশা চেতনার কণা

ধরে আছে বলে সে-ও সনাতন; কিন্তু এই ব্যর্থ ধারণা

সরিয়ে মেয়েটি তার আঁচলের চোরকাঁটা বেছে

প্রান্তর নক্ষত্র নদী আকাশের থেকে সরে গেছে

যেই স্পষ্ট নির্লিপ্তিতে তাই-ই-ঠিক; –ওখানে স্নিগ্ধ হয় সব!

অপ্রেমে বা প্রেমে নয় নিখিলের বৃক্ষ নিজ বিকাশে নীরব।


 

(২৫) স্বপ্ন

 

পান্ডুলিপি কাছে রেখে ধূসর দীপের কাছে আমি

 

নিস্তব্ধ ছিলাম বসে;

 

শিশির পড়িতেছিল ধীরে ধীরে খশে;

 

নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি

 

 

উড়ে গেল কুয়াশায়, –কুয়াশার থেকে দূর কুয়াশার আরো।

 

তাহারি পাখার হাওয়া প্রদীপ নিভায়ে গেলো বুঝি?

 

অন্ধকার হাৎড়ায়ে ধীরে-ধীরে দেশলাই খুঁজি;

 

যখন জ্বালিব আলো কার মুখ দেখা যাবে বলিতে কি পারো?

 

 

কার মুখ? –আমলকী শাখার পিছনে

 

শিঙের মতন বাঁকা নীল চাঁদ একদিন দেখেছিলো আহা,

 

সে-মুখ ধূসরতম আজ এই পৃথিবীর মনে।

 

 

তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে,

 

পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন,

 

মানুষ রবে না আর, রবে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখনঃ

 

সেই মুখ আর আমি রবো স্বপ্নের ভিতরে।

(২৬) স্থবির যৌবন

 

তারপর একদিন উজ্জ্বল মৃত্যুর দূত এসে

 

কহিবেঃ তোমারে চাই তোমারেই, নারী;

 

এই সব সোনা রূপা মশলিন যুবাদের ছাড়ি

 

চলে যেতে হবে দূর-আবিষ্কারে ভেসে।

 

 

বলিলাম; –শুনিল সে –‘তুমি তবু মৃত্যুর দূত নও-তুমি-

 

নগর-বন্দর ঢের খুঁজিয়াছি আমি;

 

তারপর তোমার এ-জানালায় থামি

 

ধোঁয়া সব; –তুমি যেন মরীচিকা-আমি মরুভূমি-

 

 

শীতের বাতাস নাকে চলে গেলো জানালার দিকে,

 

পড়িল আধেক শাল বুক থেকে খশে;

 

সুন্দর জন্তুর মতো তার দেহকোষে

 

রক্ত শুধু? দেহ শুধু? শুধু হরিণীকে

 

বাঘের বিক্ষোভ নিয়ে নদীর কিনারে নিম্নে-রাতে?

 

তবে তুমি ফিরে যাও ধোঁয়ায় আবার;

 

উজ্জ্বল মৃত্যুর দূত বিবর্ণ এবার-

 

বরং নারীকে ছেড়ে কঙ্কালের হাতে

 

 

তোমারে তুলিয়া লবে কুয়াশা-ঘোড়ায়।

 

তুমি এই পৃথিবীর অনাদি স্থবির;-

 

সোনালি মাছের মতো তবু করে ভিড়

 

নীল শৈবালের নিচে জলের মায়ায়

 

 

প্রেম-স্বপ্ন-পৃথিবীর স্বপ্ন, প্রেম তোমার হৃদয়ে।

 

হে স্থবির, কী চাও বলো তো

 

শাদা ডানা কোনো-এক সারসের মতো?

 

হয়তো সে মাংস নয় এই নারী; তবু মৃত্যু পড়ে নাই আজো তার মোহে।

 

 

তাহার ধূসর ঘোড়া চরিতেছে নদীর কিনারে

 

কোনো এক বিকেলের জাফরান দেশে।

 

কোকিল কুকুর জ্যোৎস্না ধুলো হয়ে গেছে কত ভেসে।

 

মরণের হাত ধরে স্বপ্ন ছাড়া কে বাঁচিতে পারে?

(২৭) ইহাদেরি কানে

 

একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে একবার বেদনার পানে

 

অনেক কবিয়া লিখে চলে গেলো যুবকের দল;

 

পৃথিবীর পথে-পথে সুন্দরীরা মূর্খ সসম্মানে

 

শুনিল আধেক কথা; –এই সব বধির নিশ্চল

 

সোনার পিত্তল মূর্তিঃ তবু, আহা, ইহাদেরি কানে

 

অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে গেলো যুবকের দলঃ

 

একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে একবার বেদনার পানে।

(২৮) প্রেম অপ্রেমের কবিতা

 

নিরাশার খাতে ততোধিক লোক উৎসাহ বাঁচায়ে রেখেছে;

 

অগ্নিপরীক্ষার মতো কেবলি সময় এসে দহে ফেলে দিতেছে সে-সব।

 

তোমার মৃত্যুর পরে আগুনের একতিল বেশি অধিকার

 

সিংহ মেষ কন্যা মীন করেছে প্রত্যক্ষ অনুভব।

 

পৃথিবী ক্রমশ তার আগেকার ছবি

 

বদলায়ে ফেলে দিয়ে তবুও পৃথিবী হয়ে আছে;

 

অপরিচিতের মতো সমাজ সংসার শত্রু সবই

 

পরিচিত বুনোনির মতো তবু হৃদয়ের কাছে

 

ক্রমশই মনে হয় নিজ সজীবতা নিয়ে চমৎকার,

 

আবর্তিত হয়ে যায় দানবের মায়াবলে তবুও সে-সব।

 

তোমার মৃত্যুর পরে মনিবের একতিল বেশি অধিকার

 

দীর্ঘ কালকেতু তুলে বাধা দিতে চেয়েছে রাসভ।

 

 

তোমার প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেলে তুমি চলে গেলে কবে।

 

সেই থেকে অন্য প্রকৃতির অনুভবে

 

মাঝে-মাঝে উৎকন্ঠিত হয়ে জেগে উঠেছে হৃদয়।

 

না-হলে নিরুৎসাহিত হতে হয়।

 

জীবনের, মরণের, হেমন্তের এ-রকম আশ্চর্য নিয়ম;

 

ছায়া হয়ে গেছো বলে তোমাকে এমন অসম্ভ্রম।

 

 

শত্রুর অভাব নেই, বন্ধুও বিরল নয়-যদি কেউ চায়;

 

সেই নারী ঢের দিন আগে এই জীবনের থেকে চলে গেছে।

 

ঢের দিন প্রকৃতি ও বইয়ের নিকট থেকে সদুত্তর চেয়ে

 

হৃদয় ছায়ার সাথে চালাকি করেছে।

 

তারপর অনুভব করে গেছে রমণীর ছায়া বা শরীর

 

অথবা হৃদয়,-

 

বেরালের বিকশিত হাসির মতন রাঙা গোধূলির মেঘে;

 

প্রকৃতির প্রমাণের, জীবনের দ্বারস্থ দুঃখীর মতো নয়।

 

 

তোমার সংকল্প থেকে খশে গিয়ে ঢের দূরে চলে গেলে তুমি;

 

হলেও-বা হয়ে যেতো এ-জীবনঃ দিনরাত্রির মতো মরুভূমি;-

 

তবুও হেমন্তকাল এসে পড়ে পৃথিবীতে, এমন স্তব্ধতা;

 

জীবনেও নেই কো অন্যথা

 

হেমন্তের সহোদর রয়ে গেছে, সব উত্তেজের প্রতি উদাসীন;

 

সকলের কাছ থেকে সুস্থির মনের ভাবে নিয়ে আসে ঋণ,

 

কাউকে দেয় না কিছু এমনই কঠিন;

 

সরল সে নয়, তবু ভয়াবহভাবে শাদা, সাধারণ কথা

 

জনমানুষীর কাছে বলে যায়-এমনই নিয়ত সফলতা।

(২৯) জর্নালঃ১৩৪৬

 

আজকে অনেক দিন পরে আমি বিকেলবেলায়

 

তোমাকে পেলাম কাছে,

 

শেষ রোদ এখন মাঠের কোলে খেলা করে নেভে;

 

এখন অব্যক্ত ঘুমে ভরে যায় কাচপোকা মাছির হৃদয়;

 

নদীর পাড়ের ভিজে মাটি চুপে ক্ষয়

 

হয়ে যায় অক্লান্ত ঢেউয়ের বুকে;

 

 

ঘাসে ঘুমে শান্ত হয়ে আসে ঘুঘু শালিকের গতি;

 

নিবিড় ছায়ার বুকে ক্রমে-ক্রমে পায় অব্যাহতি

 

মাঠের সমস্ত রেখা;

 

ঝাউফল ঝরে ঘাসে সান্ত্বনার মতো এসে বাতাসের হাত

 

অশ্বত্থের বুক থেকে নিভিয়ে ফেলছে খাড়া সূর্যের আঘাত;

 

এখুনি সে সরে যাবে পশ্চিমের মেঘে।

 

 

গরুর গাড়িটি কার খড়ের সুসমাচার বুকে

 

লাল বটফলে থ্যাঁতা মেঠোপথে জারুল ছায়ার নিচে নদীর সুমুখে

 

কতক্ষণ থেমে আছে; –চেয়ে দ্যাখো নদীতে পড়েছে তার ছায়া;

 

নিঃশব্দ মেঘের পাশে সমস্ত বিকেল ধরে সে-ও যেন মেঘ এক, আহা,

 

শান্ত জলে জুড়োচ্ছে;

 

 

এই সব নিস্তব্ধতা শান্তির ভিতর

 

তোমাকে পেয়েছি আজ এত দিন পরে এই পৃথিবীর পর।

 

দুজনে হাঁটছি ভরা প্রান্তরের কোল থেকে আরো-দূরে প্রান্তরের ঘাসে;

 

উশখুশু খোপা থেকে পায়ের নখটি আজ বিকেলের উৎসাহী বাতাসে

 

সচেতন হয়ে উঠে আবার নতুন করে চিনে নিতে থাকে

 

এই ব্যাপ্ত পটভূমি; –মহানিমে কোরালির ডাকে

 

হঠাৎ বুকের কাছে সব খুঁজে পেয়ে।

 

তোমার পায়ের শব্দ,’ বললে সে, ‘যেদিন শুনিনি

 

মনে হতো ব্রক্ষ্মান্ডের পরিশ্রম ধূলোর কণার কাছে তবু

 

কিছু ঋণী; ঋণী নয়?

 

সময় তা বুঝে নেবে

 

সেই সব বাসনার দিনগুলো; ঘাস রোদ শিশিরের কণা

 

তারাও জাগিয়ে গেছে আমাদের শরীরের ভিতরে কামনা

 

সেই দিন;

 

মা-মরা শিশুর মতো আকাঙ্ক্ষার মুখখানা কী যেঃ

 

ক্লান্তি আনে, ব্যথা আনে, তবুও বিরল কিছু নিয়ে আসে নিজে।

 

 

স্পষ্ট চোখ তুলে সে সন্ধ্যার দিকেঃ কত দিন অপেক্ষার পরে

 

আকাশের থেকে আজ শান্তি ঝরে অবসাদ নেই আর শূন্যের ভিতরে।

 

 

রাত্রি হয়ে গেলে তার উৎসারিত অন্ধকার জলের মতন

 

কী-এক শান্তির মতো স্নিগ্ধ হয়ে আছে এই মহিলার মন।

 

হেঁটে চলি তার পাশে, আমিও বলি না কিছু, কিছুই বলে না;

 

প্রেমও উদ্বেগ ছাড়া অন্য-এক স্থির আলোচনা

 

তার মনে; –আমরা অনেক দূর চলে গেছি প্রান্তরের ঘাসে

 

দ্রোণ ফুল লেগে আছে মেরুন শাড়িতে তার নিম-আমলকীপাতা

 

হালকা বাতাসে

 

চুলের উপরে উড়ে-উড়ে পড়ে মুখে চোখে শরীরে সর্বস্বতা ভরে

 

কঠিন এ-সামাজিক মেয়েটিকে দ্বিতীয় প্রকৃতি মনে করে।

 

 

অন্ধকার থেকে খুঁজে কখন আমার হাত একবার কোলে তুলে নিয়ে

 

গালে রেখে দিলো তারঃ রোগা হয়ে গেছো এত চাপা পড়ে

 

গেছো যে হারিয়ে

 

পৃথিবীর ভিড়ে তুমি বলে সে খিন্ন হাত ছেড়ে দিলো ধীরে;

 

শান্ত মুখে-সময়ের মুখপাত্রীর মতো সেই অপূর্ব শরীরে

 

নদী নেই-হৃদয়ে কামনা ব্যথা শেষ হয়ে গেছে কবে তার;

 

নক্ষত্রেরা চুরি করে নিয়ে গেছে, ফিরিয়ে দেবে না তারে আর;

(৩০) আকাশলীনা

 

সুরঞ্জনা, অইখানে যেয়োনাকো তুমি,

 

বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে,

 

ফিরে এসো সুরঞ্জনা;

 

নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে,

 

 

ফিরে এসো এই মাঠে; ঢেউয়ে;

 

ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;

 

দূর থেকে দূরে আরো দূরে

 

যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।

 

 

কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে!

 

আকাশের আড়ালে আকাশে

 

মৃত্তিকার মতো তুমি আজ :

 

তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।

 

 

সুরঞ্জনা,

 

তোমার হৃদয় আজ ঘাস :

 

বাতাসের ওপারে বাতাস-

 

আকাশের ওপারে আকাশ।

(৩১) সপ্তক

 

এইখানে সরোজিনী শেয়ে আছে; –জানি না সে এইখানে

 

শুয়ে আছে কিনা।

 

অনেক হয়েছে শোয়া; –তারপরে একদিন চলে গেছে

 

কোন দূর মেঘে।

 

অন্ধকার শেষ হলে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগেঃ

 

সরোজিনী চলে গেল অতদূর? সিঁড়ি ছাড়া পাখিদের

 

মতো পাখা বিনা?

 

হয়তো বা মৃত্তিকার জ্যামিতিক ঢেউ আজ? জ্যামিতির

 

ভূত বলে : আমি তো জানি না।

 

জাফরান-আলোকের বিশুষ্কতা সন্ধ্যার আকাশে আছে লেগে :

 

লুপ্ত বেড়ালের মতো; শূন্য চাতুরীর মূঢ় হাসি নিয়ে জেগে।


 

(৩২) লঘু মুহূর্ত

 

এখন দিনের শেষে তিনজন আধো আইবুড়ো ভিখিরীর

 

অত্যন্ত প্রশান্ত হলো মন;

 

ধূসর বাতাস খেয়ে এক গাল রাস্তার পাশে

 

ধূসর বাতাস দিয়ে করে নিলো মুখ আচমন।

 

কেননা এখন তারা যেই দেশে যাবে তাকে রাঙা নদী বলে,

 

সেইখানে ধোপা আর গাধা  এসে জলে

 

মুখ দেখে পরস্পরের পিঠে চড়ে জাদুবলে।

 

 

তবুও যাবার আগে তিনটি ভিখিরী মিলে গিয়ে

 

গোল হয়ে বসে গেল তিন মগ চায়ে;

 

একটি উজির, রাজা, বাকিটি কোটাল,

 

পরস্পরকে তারা নিলো বাৎলায়ে।

 

তবু এক ভিখিরিনী তিনজন খোঁড়া, খুড়ো বেয়াইয়ের টানে-

 

অথবা চায়ের মগে কুটুম হয়েছে এই জ্ঞানে

 

মিলে মিশে গেল তারা চার জোড়া কানে।

 

 

হাইড্র্যান্ট থেকে কিছু জল ঢেলে চায়ের ভিতরে

 

জীবনকে আরো স্থির, সাধুভাবে তারা

 

ব্যবহার করে নিতে গেল সোঁদা ফুটপাতে বসে;

 

মাথা নেড়ে দুঃখ করে বলে গেল : জলিফলি ছাড়া

 

চেৎলার হাট থেকে টালার জলের কল আজ

 

এমন কি হতো জাঁহাবাজ?

 

ভিখিরীকে একটি পয়সা দিতে ভাসুর ভাদ্র-বৌ সকলে নারাজ।

 

 

বলে তারা রামছাগলের মতো রুখু দাড়ি নেড়ে

 

একবার চোখ ফেলে মেয়েটির দিকে

 

অনুভব করে নিলো এইখানে চায়ের আমেজে

 

নামায়েছে তারা এক শাঁকচুন্নীকে

 

এ-মেয়েটি হাঁস ছিলো একদিন হয়তো বা এখন হয়েছে হাঁসহাঁস।

 

দেখে তারা তুড়ি দিয়ে বার করে দিলো তাকে আরেক গেলাসঃ

 

আমাদের সোনা রুপো নেই, তবু আমরা কে কার ক্রীতদাস?

 

 

এ-সব সফেন কথা শুনে এক রাতচরা ডাঁশ

 

লাফায়ে লাফায়ে যায় তাহাদের নাকের ডগায়;

 

নদীর জলের পারে বসে যেন, বেন্টিঙ্ক ষ্ট্রিটে

 

তাহারা গণনা করে গেল এই পৃথিবীর ন্যায় অন্যায়;

 

চুলের এঁটিলি মেরে গুনে গেল অন্যায় ন্যায়

 

কোথায় ব্যয়িত হয়-কারা করে ব্যয়;

 

কী কী দেয়া-থোয়া হয় কারা কাকে দেয়;

 

 

কী করে ধর্মের কল নড়ে যায় মিহিন বাতাসে,

 

মানুষ্টা মরে গেলে যদি তাকে ওষুধের শিশি

 

কেউ দেয়-বিনি দামে-তবে কার লাভ-

 

এই নিয়ে চারজনে করে গেল ভীষণ সালিশী।

 

কেননা এখন তারা যেই দেশে যাবে তাকে উড়ো নদী বলে;

 

সেইখানে হাঢ়াভাতে ও হাড় এসে জলে

 

মুখ দ্যাখে-যতদিন মুখ দেখা চলে।


 

(৩৩) দীপ্তি

 

তোমার নিকট থেকে

 

যত দূর দেশে

 

আমি চলে যাই

 

তত ভালো।

 

সময় কেবলি নিজ নিয়মের মতো; –তবু কেউ

 

সময়স্রোতের পরে সাঁকো

 

বেঁধে নিতে চায়;

 

ভেঙ্গে যায়;

 

 

 

 

যত ভাঙ্গে তত ভালো।

 

যত স্রোতে বয়ে যায়

 

সময়ের

 

সময়ের মতন নদীর

 

জলসিঁড়ি নীপার, ওডার; রাইন, রেবা, কাবেরীর

 

তুমি তত বয়ে যাও,

 

আমি তত বয়ে চলি,

 

তবুও কেহই কারু নয়।

 

 

 

আমরা জীবন তবু।

 

 

 

তোমার জীবন নিয়ে তুমি

 

সূর্যের রশ্মির মতো অগণন চুলে

 

রৌদ্রের বেলার মতো শরীরের রঙে

 

খরতর নদী হয়ে গেলে

 

হয়ে যেতে।

 

তবুও মানুষী হয়ে

 

পুরুষের চেয়ে বড়ো জীবনের হয়তো বা।

 

আমিও জীবন তবু;-

 

ক্কচিৎ তোমার কথা ভেবে

 

তোমার সে-শরীরের থেকে ঢের দূরে চলে গিয়ে

 

কোথাও বিকেলবেলা নগরীর উৎসারণে উচল সিঁড়ির

 

উপরে রৌদ্রের রঙ জ্বলে ওঠে-দেখে

 

বুদ্ধের চেয়েও আরো দীন সুষমায় সুজাতার

 

মৃত বৎসকে বাঁচায়েছে

 

কেউ যেন;

 

মনে হয়,

 

দেখা যায়।

 

 

 

কেউ নেই-স্তব্ধতায়; –তবুও হৃদয়ে দীপ্তি আছে।

 

 

 

দিন শেষ হয়নি এখনো।

 

জীবনের দিন-কাজ-

 

শেষ হতে আজো ঢের দেরি।

 

অন্ন নেই। হৃদয়বিহীনভাবে আজ

 

মৈত্রেয়ী ভূমার চেয়ে অন্নলোভাতুর।

 

রক্তের সমুদ্র চারিদিকে;

 

কলকাতা থেকে দূর

 

গ্রীসের অলিভ-বন

 

 

 

অন্ধকার।

 

অগণন লোক মরে যায়;

 

এম্পিডোক্লেসের মৃত্যু নয়;-

 

সেই মৃত্যু ব্যসনের মতো মনে হয়।

 

 

 

এ ছাড়া কোথাও কোনো পাখি

 

বসন্তের অন্য কোনো সাড়া নেই।

 

তবু এক দীপ্তি রয়ে গেছে।


 

(৩৪) আমাকে একটি কথা দাও

 

আমাকে একটি কথা দাও যা আকাশের মতো

 

সহজ মহৎ বিশাল,

 

গভীর; –সমস্ত ক্লান্ত হতাহত গৃহবলিভুকদেররক্তে

 

মলিন ইতিহাসের অন্তর ধুয়ে চেনা হাতের মতন,

 

আমি যাকে আবহমান কাল ভালোবেসে এসেছি সেই নারীর।

 

সেই রাত্রির নক্ষত্রালোকিত নিবিড় বাতাসের মতোঃ

 

সেই দিনের আলোর অন্তহীন এঞ্জিন-চঞ্চল ডানার মতন

 

সেই উজ্জ্বল পাখিনীর পাখির সমস্ত পিপাসাকে যে

 

আগ্নির মতো প্রদীপ্ত সেখে অন্তিমশরোরিণি মোমের মতন।

 


 

(৩৫) তোমাকে

 

মাঠের ভিড়ে গাছের ফাঁকে দিনের রৌদ্র ঐ;

 

কূল্বধূর বহিরাশ্রয়িতার মতন অনেকে উড়ে

 

হিজল গাছে জামের বনে হলুদপাখির মতো

 

রূপসাগরের পার থেকে কি পাখনা বাড়িয়ে

 

বাস্তবিকই রৌদ্র এখন? সত্যিকারের পাখি?

 

কে যে কোথায় কার হৃদয়ে কখন আঘাত করে।

 

 

 

রৌদ্রবরণ দেখেছিলাম কঠিন সময়-পরিক্রমার পথে-

 

নারীর, –তবু ভেবেছিলাম বহিঃপ্রকৃতির।

 

আজকে সে-সব মীনকেতনের সাড়ার মতো, তবু

 

অন্ধকারের মহাসনাতনের থেকে চেয়ে;

 

আশ্বিনের এই শীত স্বাভাবিক ভোরের বেলা হলে

 

বলেঃ আমি রোদ কি ধুলো পাখি না সেই নারী?

 

পাতা পাখর মৃত্যু কাজের ভূকন্দরের থেকে আমি শুনি;

 

নদী শিশির পাখি বাতাস কথা বলে ফুরিয়ে গেলে পরে

 

শান্ত পরিচ্ছন্নতা এক এই পৃথিবীর প্রাণে

 

সফল হতে গিয়েও তবু বিষণ্নতার মতো।

 

যদিও পথ আছে তবু কোলাহলে শূন্য আলিঙ্গনে

 

নায়ক সাধক রাষ্ট্র সমাজ ক্লান্ত হয়ে পড়ে;

 

প্রতিটি প্রাণ অন্ধকারে নিজের আত্মবোধের দ্বীপের মতো-

 

কী এক বিরাট অবক্ষয়ের মানব-সাগরে।

 

তবুও তোমায় জেনেছি, নারি, ইতিহাসের শেষে এসে; মানবপ্রতিভার

 

রূঢ়তা ও নিস্ফলতার অধম অন্ধকারে

 

মানবকে নয়, নারি, শুধু তোমাকে ভালোবেসে

 

বুঝেছি নিখিল বিষ কী রকম মধুর হতে পারে।

(৩৬) অনেক নদীর জল

 

অনেক নদীর জল উবে গেছে-

 

ঘর বাড়ি সাঁকো ভেঙ্গে গেল,

 

সে সব সময় ভেদ করে ফেলে আজ

 

কারা তবু কাছে চলে এলো।

 

-মানে তাকে দেখা যেত যদি-

 

যে-নারী দেখে নি কেউ সাতটি তারার তিমিরে

 

হৃদয়ে এসেছে সেই নদী।

 

 

তুমি কথা বল-আমি জীবন মৃত্যুর শব্দ শুনিঃ

 

সকালে শিশিরকণা যে-রকম ঘাসে

 

অচিরে মরণশীল হয়ে তবু সূর্য আবার

 

মৃত্যু মুখে নিয়ে পরদিন ফিরে আসে।

 

জন্মতারকার ডাকে বার বার পৃথিবীতে ফিরে এসে আমি

 

দেখেছি তোমার চোখে একই ছায়া পড়েঃ

 

সে কি প্রেম? অন্ধকার?-ঘুম মৃত্যু প্রকৃতির

 

অন্ধ চলাচলের ভিতরে।

 

স্থির হয়ে আছে মন; মনে হয় তবু

 

সে ধ্রুব গতির বেগে চলে,

 

মহা-মহা রজনীর ব্রক্ষ্মান্ডকে ধরে,

 

সৃষ্টির গভীর গভীর হংসী প্রেম

 

নেমেছে এসেছে আজ রক্তের ভিতরে।

 

এখানে পৃথিবীর আর নেই-

 

বলে তাহা পৃথিবীর জনকল্যাণেই

 

বিদায় নিয়েছে হিংসা ক্লান্তির পানে,

 

কল্যাণ কল্যাণ; এই রাত্রির গভীরতর মানে।

 

শান্তি এই আজ;

 

এইখানে স্মৃতি;

 

এইখানে বিস্মৃতি তবু; প্রেম

 

ক্রমায়াত আধাঁরকে আলোকিত, করার প্রমিতি।


 

(৩৭) সূর্য নক্ষত্র নারী

 

তোমার নিকট থেকে সর্বদাই বিদায়ের কথা ছিল

 

সব চেয়ে আগে; জানি আমি।

 

সে-দিনও তোমার সাথে মুখ-চেনা হয় নাই।

 

তুমি যে এ-পৃথিবীতে রয়ে গেছ

 

আমাকে বলে নি কেউ।

 

কোথাও জলকে ঘিরে পৃথিবীর অফুরান জল

 

য়ে গেছে;-

 

যে যার নিজের কাজে আছে, এই অনুভবে চলে

 

শিয়রে নিয়ত স্ফীত সূর্যকে চেনে তারা;

 

আকাশের সপ্রতিভ নক্ষত্রকে চেনে উদীচীর

 

কোনো জল কী করে অপর জল চিনে নেবে অন্য নির্ঝরের?

 

তবুও জীবন ছুঁয়ে গেলে তুমি;-

 

আমার চোখের থেকে নিমেষনিহত

 

সূর্যকে সরায়ে দিয়ে।

 

সরে যেত; তবুও আয়ুর দিন ফুরোবার আগে

 

নব-নব সূর্যকে কে নারীর বদলে

 

ছেড়ে দেয়? কেন দেব? সকল প্রতীতি উৎসবের

 

চেয়ে তবু বড়

 

স্থিরতর প্রিয় তুমি; –নিঃসূর্য নির্জন

 

রে দিতে এলে।

 

মিলন ও বিদায়ের প্রয়োজনে আমি যদি মিলিত হতাম

 

তোমার উৎসের সাথে, তবে আমি অন্য সব প্রেমিকের মতো

 

বিরাট পৃথিবী আর সুবিশাল সময়কে সেবা করে-আত্মস্থ হতাম।

 

তুমি তা জান না, তবু, আমি জানি। একবার তোমাকে দেখেছি;

 

পিছনের পটভূমিকায় সময়ের

 

শেষনাগ ছিল, নেই;-বিজ্ঞানের ক্লান্ত নক্ষত্রেরা

 

নিভে যায়; –মানুষ অপরিজ্ঞাত সে-অমায়; তবুও তাদের একজন

 

গভীর মানুষী কেন নিজেকে চেনায়!

 

আহা, তাকে অন্ধকার অনন্তের মতো আমি জেনে নিয়ে, তবু,

 

অল্পায়ু রঙিন রৌদ্রে মানবের ইতিহাসকে না জেনে কোথায় চলেছি!

 

 

দুই

 

চারিদিকে সৃজনের অন্ধকার রয়ে গেছে নারি,

 

অবতীর্ণ শরীরের অনুভূতি ছাড়া আরো ভালো

 

কোথাও দ্বিতীয় সূর্য নেই, যা জ্বালালে

 

তোমার শরীর সব আলোকিত করে দিয়ে স্পষ্ট করে দেবে কোনো কালে

 

শরীরে যা রয়ে গেছে।

 

এই সব ঐশী কাল ভেঙ্গে ফেলে দিয়ে

 

নতুন সময় গড়ে নিজেকে না গড়ে তবু তুমি

 

ব্রক্ষ্মান্ডের অন্ধকারে একবার জন্মাবার হেতু

 

অনুভব করেছিলে;-

 

জন্ম-জন্মান্তের মৃত স্মরণের সাঁকো

 

তোমার হৃদয় স্পর্শ করে বলে আজ

 

আমাকে ইসারাপাত করে গেলে তারি;-

 

অপার কালের স্রোত না পেলে কী করে তবু নারি,

 

তুচ্ছ, খন্ড, অল্প সময়ের স্বত্ব কাটায়ে অঋণী তোমাকে কাছে পাবে-

 

তোমার নিবিড় নিজ চোখ এসে নিজের বিষয় নিয়ে যাবে?

 

সময়ের কক্ষ থেকে দূর কক্ষে চাবি

 

খুলে ফেলে তুমি অন্য সব মেয়েদের

 

আত্মঅন্তরঙ্গতার দান

 

দেখায়ে অনন্তকাল ভেঙ্গে গেলে পরে

 

যে-দেশে নক্ষত্র নেই-কোথাও সময় নেই আর-

 

আমারো হৃদয়ে নেই বিভা-

 

দেখাবে নিজের হাতে-অবশেষে-কী মকরকেতনে প্রতিভা!

 

 

 

তিন

 

তুমি আছ জেনে আমি অন্ধকার ভালো ভেবে যে-অতীত আর

 

যেই শীত ক্লান্থীন কাটিয়েছিলাম,

 

তাই শুধু কাটায়েছি

 

কাটায়ে জেনেছি এই-ই শুন্য, তবু হৃদয়ের কাছে ছিল অন্য কোনো নাম।

 

অন্তহীন অপেক্ষার চেয়ে তবে ভালো

 

দ্বীপাতীত লক্ষ্যে অবিরাম চলে যাওয়া।

 

শোককে স্বীকার করে অবশেষে তবে

 

নিমেষের শরীরের উজ্জ্বলতায় অনন্তের জ্ঞানপাপ মুছে দিতে হবে।

 

আজ এই ধ্বংসমত্ত অন্ধকার ভেদ করে বিদ্যুতের মতো

 

তুমি যে শরীর নিয়ে রয়ে গেছ, সেই কথা সময়ের মনে

 

জানাবার আধার কি একজন পুরুষের নির্জন শরীরে

 

একটি পলক শুধু হৃদয়বিহীন সব অপার আলোকবর্ষ ঘিরে?

 

অধঃপতিত এই অসময়ে কে-বা সেই উপচার পুরুষমানুষ?-

 

ভাবি আমি; –জানি আমি তবু

 

যে-কথা আমাকে জানাবার

 

হৃসয় আমার নেই;-

 

যে-কোনো প্রেমিক আজ এখন আমার

 

দেহের প্রতিভূ হয়ে নিজের নারীকে নিয়ে পৃথিবীর পথে

 

একটি মুহূর্তে যদি আমার অনন্ত হয় মহিলার জ্যোতিষ্ক জগতে।


 

(৩৮) মহিলা

 

এইখানে শূন্যে অনুধাবনীয় পাহাড় উঠেছে

 

ভোরের ভিতর থেকে অন্য এক পৃথিবীর মতো,

 

এইখানে এসে পড়ে থেমে গেলে একটি নারীকে

 

কোথাও দেখেছি বলে স্বভাববশত

 

 

মনে হয়; –কেননা এমন স্থান পাথরের ভারে কেটে তবু

 

প্রতিভাত হয়ে থাকে নিজের মতন লঘুভারে;

 

এইখানে সেদিনও সে হেঁটেছিল, –আজো ঘুরে যায়;

 

এর চেয়ে বেশি ব্যাখ্যা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন দিতে পারে;

 

দিনগত পাপক্ষয় ভুলে গিয়ে হৃদয়ের দিন

 

ধারণ করেছে তার শরীরে ফাঁস।

 

 

চিতাবাঘ জন্মাবার আগে এই পাহাড়ে সে ছিল;

 

অজগর সাপিনীর মরণের পরে।

 

সহসা পাহাড় বলে মেঘ-খন্ডকে

 

শূন্যের ভিতরে

 

 

 

ভুল হলে প্রকৃতিস্থ হয়ে যেতে হয়;

 

(চোখ চেয়ে ভালো করে তাকালেই হত;)

 

কেননা কেবলি যুক্তি ভালবেসে আমি

 

প্রমাণের অভাববশত

 

 

 

তাহাকে দেখিনি তবু আজো;

 

এক আচ্ছন্নতা খুলে শতাব্দী নিজের মুখের নিস্ফলতা

 

দেখাবার আগে নেমে ডুবে যায় দ্বিতীয় ব্যথায়;

 

আদার ব্যাপারী হয়ে এই সব জাহাজের কথা

 

 

 

না ভেবে মানুষ কাজ করে যায় শুধু

 

ভয়াবহভাবে অনায়াসে।

 

কখনো সম্রাট শনি শেয়াল ও ভাঁড়

 

সে-নারীর রাং দেখে হো-হো করে হাসে।

 

 

 

দুই

 

মহিলা তবুও নেমে আসে মনে হয়;

 

(বমারের কাজ সাঙ্গ হলে

 

নিজের এয়োরোড্রামে-প্রাশান্তির মতো?)

 

আছেও জেনেও জনতার কোলাহলে

 

তাহার মনের ভাব ঠিক কী রকম-

 

আপনারা স্থির করে নিন;

 

মনে পড়ে, সেন রায় নওয়াজ কাপুর

 

আয়াঙ্গার আপ্তে পেরিন-

 

 

 

এমনই পদবী ছিল মেয়েটির কোনো একদিন;

 

আজ তবু উনিশ শো বেয়াল্লিশ সাল;

 

সম্বর মৃগের বেড় জড়ায়েছে যখন পাহাড়ে

 

কখনও বিকেলবেলা বিরাট ময়লা,

 

 

 

অথবা যখন চিল শরতের ভোরে

 

নীলিমার আধপথে তুলে নিয়ে গেছে

 

রঁসুয়েক ঠোনা দিয়ে অপরূপ চিতলের পেটি,-

 

সহসা তাকায়ে তারা উৎসারিত নারীকে দেখেছে;

 

 

 

এক পৃথিবীর মৃত্যু প্রায় হয়ে গেলে

 

অন্য-এক পৃথিবীর নাম

 

অনুভব করে নিতে গিয়ে মহিলার

 

ক্রমেই জাগছে মনস্কার;

 

 

 

ধূমবতী মাতঙ্গী কমলা দশ-মহাবিদ্যা নিজেদের মুখ

 

দেখায়ে সমাপ্ত হলে সে তার নিজের ক্লান্ত পায়ের সঙ্কেতে

 

পৃথিবীকে জীবনের মতো পরিসর দিতে গিয়ে

 

যাদের প্রেমের তরে ছিল আড়ি পেতে

 

 

 

তাহারা বিশেষ কেউ কিছু নয়;-

 

এখনও প্রাণের হিতাহিত

 

না জেনে এগিয়ে যেতে চেয়ে তবু পিছু হটে গিয়ে

 

হেসে ওঠে গৌড়জনোচিত

 

গরম জলের কাপে ভবেনের চায়ের দোকানে;

 

উত্তেজিত হয়ে মনে করেছিল (কবিদের হাড়

 

যতদূর উদ্বোধিত হয়ে যেতে পারে-

 

যদিও অনেক কবি প্রেমিকের হাতে স্ফীত হয়ে গেছে রাঁঢ়):

 

 

 

উনিশ শো বেয়াল্লিশ সালে এসে উনিশ শো পঁচিশের জীব-

 

সেই নারী আপনার হংসীশ্বেত রিরিংসার মতন কঠিন;

 

সে না হলে মহাকাল আমাদের রক্ত ছেঁকে নিয়ে,

 

বার করে নিত না কি জনসাধারণভাবে স্যাকারিন।

 

 

 

আমাদের প্রাণে সেই অসন্তোষ জেগে ওঠে, সেই স্থির করে;

 

পুনরায় বেদনাইয় আমাদের সব মুখ স্থুল হয়ে গেলে

 

গাধার সুদীর্ঘ কান সন্দেহের চোখে দেখে তবু

 

শকুনের শেয়ালের চেকনাই কান কেটে ফেলে।


 

(৩৯) পটভূমির

 

পটভূমির ভিতরে গিয়ে কবে তোমায় দেখেছিলাম আমি

 

দশ-পনের বছর আগে; সময় তখন তোমার চুলে কালো

 

মেঘের ভিতর লুকিয়ে থেকে বিদ্যুৎ জ্বালালো

 

তোমার নিশিত নারীমুখের; –জানো তো অন্তর্যামী।

 

তোমার মুখঃ চারিদিকে অন্ধকারে জলের কোলাহল।

 

কোথাও কোনো বেলাভূমির নিয়ন্তা নেই, –গভীর বাতাসে

 

তবুও সব রণক্লান্ত অবসন্ন নাবিক ফিরে আসে;

 

তারা যুবা, তারা মৃত; মৃত্যু অনেক পরিশ্রমের ফল।

 

সময় কোথাও নিবারিত হয় না, তবু তোমার মুখের পথে

 

আজো তাকে থামিয়ে একা দাঁড়িয়ে আছ, নারি,-

 

হয়তো ভোরে আমরা সবাই মানুষ ছিলাম, তারি

 

নিদর্শনের সূর্যবলয় আজকের এই অন্ধ জগতে।

 

চারিদিকে অলীক সাগর-জ্যাসন ওডিসিযুস ফিনিশিয়

 

সার্থবাহের অধীর আলো, –ধর্মাশোকের নিজের তো নয়, আপতিতকাল

 

আমরা আজো বহন করে, সকল কঠিন সমুদ্রে প্রবাল

 

লুটে তোমার চোখের বিষাদ ভৎসনাপ্রেম নিভিয়ে দিলাম, প্রিয়।


 

(৪০) সময়ের তীরে

 

নিচে হতাহত সৈন্যদের ভিড় পেরিয়ে,

 

মাথার ওপর অগণন নক্ষত্রের আকাশের দিকে তাকিয়ে,

 

কোনো দূর সমুদ্রের বাতাসের স্পর্শ মুখে রেখে,

 

আমার শরীরের ভিতর অনাদি সৃষ্টির রক্তের গুঞ্জরণ শুনে,

 

কোথায় শিবিরে গিয়ে পৌঁছলাম আমি।

 

সেখানে মাতাল সেনানায়কেরা

 

মদকে নারীর মত ব্যবহার করছে,

 

নারীকে জলের মতো;

 

তাদের হৃদয়ের থেকে উত্থিত সৃষ্টিবিসারী গানে

 

নতুন সমুদ্রের পারে নক্ষত্রের নগ্নলোক সৃষ্টি হচ্ছে যেন;

 

কোথাও কোনো মানবিক নগর বন্দর মিনার খিলান নেই আর;

 

এক দিকে বালিপ্রলেপী মরুভূমি হু-হু করছে,

 

আর এক দিকে ঘাসের প্রান্তর ছড়িয়ে আছে-

 

আন্তঃনাক্ষত্রিক শূন্যের মতো অপার অন্ধকারে মাইলের পর মেইল।

 

 

শুধু বাতাস উড়ে আসছেঃ

 

স্থলিত নিহত মনুষ্যত্বের শেষ সীমানাকে

 

সময়সেতুলোকে বিলীন করে দেবার জন্যে,

 

উচ্ছ্বিত শববাহকের মূর্তিতে।

 

শুধু বাতাসের প্রেতচারণ

 

অমৃতলোকের অপস্রিয়মান নক্ষত্রযান-আলোর স্নধানে।

 

পাখি নেই, –সেই পাখীর কঙ্কালের গুঞ্জরণ;

 

কোনো গাছ নেই, –সেই তুঁতের পল্লবের ভিতর থেকে

 

অন্ধ অন্ধকার তুষারপিচ্ছিল এক শোণ নদীর নির্দেশে।

 

 

সেখানে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হল, নারি,

 

অবাক হলাম না।

 

হতবাক হবার কি আছে?

 

তুমি যে মর্ত্যনারকী ধাতুর সংঘর্ষ থেকে জেগে উঠেছ নীল

 

স্বর্গীয় শিখার মতো;

 

সকল সময় স্থান অনুভব্লোক অধিকার করে সে তো থাকবে

 

এইখানেই,

 

আজ আমাদের এই কঠিন পৃথিবীতে।

 

 

কোথাও মিনারে তুমি নেই আজ আর

 

জানালার সোনালি নীল কমলা সবুজ কাচের দিগন্তে;

 

কোথাও বনচ্ছবির ভিতরে নেই;

 

শাদা সাধারণ নিঃসঙ্কোচ রৌদ্রের ভিতরে তুমি নেই আজ।

 

অথবা ঝর্ণার জলে

 

মিশরী শঙ্খরেখাসর্পিল সাগরীয় সমুৎসুকতায়

 

তুমি আজ সূর্যজলস্ফুলিঙ্গের আত্মা-মুখরিত নো আর?

 

তোমাকে আমেরিকার কংগ্রেস-ভবনে দেখতে চেয়েছিলাম,

 

কিংবা ভারতের;

 

অথবা ক্রেমলিনে কি বেতসতম্বী সূর্যশিখার কোনো স্থান আছে

 

যার মানে পবিত্রতা শান্তি শক্তি সুভ্রতা-সকলের জন্যে!

 

নিঃসীম শূন্যে শূন্যের সংঘর্ষে স্বতরুৎসারা নীলিমার মতো

 

কোনো রাষ্ট্র কি নেই আজ আর

 

কোনো নগরী নেই

 

সৃষ্টির মরালীকে যা বহন করে চলেছে মধু বাতাসে

 

নক্ষত্রে-লোক থেকে সূর্যলোকান্তরে!

 

 

ডানে বাঁইয়ে ওপরে নীচে সময়ের

 

জলন্ত তিমিরের ভিতর তোমাকে পেয়েছি।

 

শুনেছি বিরাট শ্বেতপক্ষিসূর্যের

 

ডানার উড্ডীন কলরোল;

 

আগুনের মহান পরিধি গান করে উঠছে।


 

(৪১) যদিও দিন

 

যদিও দিন কেবলি নতুন গল্পবিশ্রুতির

 

তারপরে রাত অন্ধকারে থেমে থাকাঃ-লুপ্তপ্রায় নীড়

 

সঠিক করে নেয়ার মতো শান্ত কথা ভাবা;

 

যদিও গভীর রাতের তারা (মনে হয়) ঐশী শক্তির;

 

তবুও কোথায় এখন আর প্রতিভা আভা নেই;

 

অন্ধকারে কেবলি সময় হৃদয় দেশ ক্ষয়ে

 

যেতেছে দেখে নীলিমাকে অসীম করে তুমি

 

বলতে যদি মেঘনা নদীর মতন অকুল হয়ে;

 

 

 

আমি তোমার মনের নারী শরীরিণী জানি;

 

কেন তুমি স্তব্ধ হয়ে থাকো।

 

তুমি আছ বলে আমি কেবলই দূরে চলতে ভালোবাসি,

 

চিনি না কোনো সাঁকো।

 

 

 

যতটা দূর যেতেছি আমি সূর্যকরোজ্জ্বলতাময় প্রাণে

 

ততই তোমার সত্ত্বাধিকার ক্ষয়

 

পাচ্ছে বলে মনে কর? তুমি আমার প্রাণের মাঝে দ্বীপ,

 

কিন্তু সে-দ্বীপ মেঘনা নদী নয়।’-

 

 

 

এ কথা যদি জলের মতো উৎসারণে তুমি

 

আমাকে-তাকে-যাকে তুমি ভালোবাস তাকে

 

লে যেতে; –শুনে নিতাম; মহাপ্রাণের বৃক্ষ থেকে পাখি

 

শোনে যেমন আকাশ বাতাস রাতের তারকাকে।


 

(৪২) মহাগোধুলি

 

সোনালি খড়ের ভারে অলস গোরুর গাড়ি-বিকেলের রোদ পড়ে আসে

 

কালো নীল হলদে পাখিরা ডানা ঝাপটায় ক্ষেতের ভাঁড়ারে;

 

শাদা পথ ধুলো মাছি-ঘুম হয়ে মিশছে আকাশে;

 

অস্ত-সূর্য গা এলিয়ে অড়র ক্ষেতের পারে-পারে

 

শুয়ে থাকে; রক্তে তার এসেছে ঘুমের স্বাদ এখন নির্জনে;

 

আসন্ন এ-ক্ষেতটিকে ভালো লাগে-চোখে অগ্নি তার

 

নিভে-নিভে জেগে ওঠে; স্নিগ্ধ কালো অঙ্গারের গন্ধ এসে মনে

 

একদিন আগুনকে দেবে নিস্তার।

 

 

কোথায় চার্টার প্যাক্ট কমিশন প্ল্যান ক্ষয় হয়;

 

কেন হিংসা ঈর্ষা গ্লানি ক্লান্তি ভয় রক্ত কলরবঃ

 

বুদ্ধের মৃত্যুর পরে যেই তন্বী ভিক্ষুণিকে এই প্রশ্ন আমার হৃদয়

 

রে চুপ হয়েছিল-আজও সময়ের কাছে তেমনি নীরব।


 

(৪৩) মানুষ যা চেয়েছিল

 

গোধূলির রঙ লেগে অশত্থ বটের পাতা হতেছে নরম;

 

খয়েরী শালিখগুলো খেলছে বাতাবীগাছে তাদের পেটের শাদা রোম

 

সবুজ পাতার নীচে ঢাকা পড়ে একেবার পলকেই বার হয়ে আসে,

 

হলুদ পাতার কোলে কেঁপে-কেঁপে মুছে যায় সন্ধ্যার বাতাসে।

 

ও কার গোরুর গাড়ি রয়ে গেছে ঘাসে ঐ পাখা মেলে ফড়িঙের মতো।

 

হরিণী রয়েছে বসে নিজের শিশুর পাশে বড় চোখ মেলে;

 

আঁকা-বাঁকা শিং ছুঁয়ে তাদের মেরুন গোধুলির

 

মেঘগুলো লেগে আছে; সবুজ ঘাসের পরে ছবির মতন যেন স্থির;

 

দিঘির জলের মতো ঠান্ডা কালো নিশ্চিন্ত চোখ,

 

সৃষ্টির বঞ্চনা ক্ষমা করবার মতন অশোক

 

অনুভূতি জেগে ওঠে মনে।

 

আঁধার নেপথ্য সব চারিদিকে-

 

কুল থেকে অকুলের দিক নিরূপণে

 

শক্তি নেই আজ আর পৃথিবীর-

 

তবু এই স্নিগ্ধ রাত্রি নক্ষত্রে ঘাসে;

 

কোথাও প্রান্তরে ঘরে অথবা বন্দরে নীলাকাশে;

 

মানুষ যা চেয়েছিল সেই মহাজিজ্ঞাসার শান্তি দিতে আসে।


 

(৪৪) আজকের রাতে

 

আজকে রাতে তোমায় আমার কাছে পেলে কথা

 

বলা যেত; চারিদিকে হিজল শিরীষ নক্ষত্র ঘাস হাওয়ার প্রান্তর

 

কিন্তু যেই নিট ভাবনা আবেগ ভাব

 

বিশুদ্ধ হয় বিষয় ও তার যুক্তির ভিতর;-

 

 

আমিও সেই ফলাফলের ভিতরে থেকে গিয়ে

 

দেখেছি ভারত লন্ডন রোম নিউইয়র্ক চীন

 

আজকে রাতের ইতিহাস ও মৃত ম্যামথ সব

 

নিবিড় নিয়মাধীন।

 

 

কোথায় তুমি রয়েছ কোন পাশার দান হাতেঃ

 

কী কাজ খুঁজে; –সকল অনুশীলন ভালো নয়;

 

গভীর ভাবে জেনেছি যে-সব সকাল বিকাল নদী নক্ষত্রকে

 

তারি ভিতর প্রবীন গল্প নিহিত হয়ে রয়।


 

(৪৫) হে হৃদয়

 

হে হৃদয়;

 

নিস্তব্ধতা?

 

চারিদিকে মৃত সব অরণ্যেরা বুঝি?

 

মাথার উপরে চাঁদ

 

চলছে কেবলি মেঘ কেটে পথ খুঁজে-

 

 

পেঁচার মাখায়

 

জোনাকির গায়ে

 

ঘাসের ওপরে কী যে শিশিরের মতো ধূসরতা

 

দীপ্ত হয় না কিছু?

 

ধ্বনিও হয় না আর?

 

 

হলুদ দুঠ্যাং তুলে নেচে রোগা শালিখের মতো যেন কথা

 

লে চলে তবুও জীবনঃ

 

বয়স তোমার কত? চল্লিশ বছর হল?

 

প্রণয়ের পালা ঢের এল গেল-

 

হল না মিল

 

পর্বতের পথে-পথে রৌদ্রে রক্তে অক্লান্ত সফরে

 

খচ্চরের পিঠে কারা চড়ে?

 

পতঞ্জলি এসে বলে দেবে

 

প্রভেদ কী যারা শুধু বসে থেকে ব্যথা পায় মৃত্যুর গহ্বরে

 

মুখে রক্ত তুলে যারা খচ্চরের পিঠে থেকে পড়ে যায়?

 

 

মৃত সব অরণ্যেরা;

 

আমার এ-জীবনের মৃত অরণ্যেরা বুঝি বলেঃ

 

কেন যাও পৃথিবীর রৌদ্র কোলাহলে

 

নিখিল বিষের ভোক্তা নীলকন্ঠ আকাশের নীচে

 

কেন চলে যেতে চাও মিছে;

 

কোথাও পাবে না কিছু;

 

মৃত্যুই অনন্ত শান্তি হয়ে

 

অন্তহীন অন্ধকারে আছে

 

লীন সব অরণ্যের কাছে।

 

 

আমি তবু বলিঃ

 

এখনও যে-কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে-সূর্যে চলি,

 

দেখা যাক পৃথিবীর ঘাস

 

সৃষ্টির বিষের বিন্দু আর

 

নিষ্পেষিত মনুষ্যতার

 

আঁধারের থেকে আনে কী করে যে মহা-নীলাকাশ,

 

ভাবা যাক-ভাবা যাক-

 

ইতিহাস খুঁড়লেই রাশি-রাশি দুঃখের খনি

 

ভেদ করে শোনা যায় শুশ্রূষার মতো শত-শত

 

শত জলঝর্ণার ধ্বনি।


No comments:

© 2007-2023 IQBAL AHSAN