দুই প্রতিবেশী - iqbal's blog
একটি চিনা গল্পের অনুকরণে

লাওফং এবং লাওলিন দুজন পরষ্পরের পরিবারসহ শহড়ের একটি দালানে বাস করে। তারা দুজনে একে অপরের প্রতিবেশী। দুই পরিবার একই রান্নাঘর এবং বাথরুম ব্যবহার করে। দুই পরিবারই পরষ্পরকে নানাভাবে সাহায্য করে এবং শান্তির সাথে বসবাস করে। যাকে বলে আদর্শ প্রতিবেশী।

যদিও দু’পরিবারের মধ্যে প্রচন্ড মিল, এরা কিন্তু কিছুদিন পূর্বে একে অপরকে চিনতেন না। থাকতেনও আলাদা বাড়িতে। কিছুদিন আগে তারা দু’জনে এক সঙ্গে বাস থেকে নেমে যে যার বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছিলেন। লাওফঙের হাতে একটা হৃষ্টপুষ্ট মুরগী দেখে লাওলিন তাকে জিজ্ঞেস করে, এত ভালো মুরগী তিনি কোথা থেকে কিনেছেন আর কতই এর দাম।

জবাবে লাওফং জানালো যে সে শহড়ের উপকন্ঠে একটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক, মুরগীটা তিনি গ্রামের একজনের কাছ থেকে বেশ সস্তায় কিনেছেন। তিনি আরো জানালেন যে ওদিকের গ্রামে প্রায়ই কমদামে ভালো ভালো জিনিস পাওয়া যায়।

লাওলিন তখন আফসোস করে বললেন, এমন সুবিধা তিনিও যদি মাঝে মাঝে পেতেন, তাহলে ভালোই হত। এরপর কথায় কথায় লাওফং জানতে পারলেন, লাওলিন সরকারী সংস্থার কর্মসংস্থান বিভাগে কাজ করে। তখন লাওফং খুব আন্তরিক ভাবে বললেন, ‘আপনার যখনই কোন কিছুর দরকার হবে আমাকে বলবেন, বললেই তা আমি গ্রাম থেকে নিয়ে আসবো। এতে আর অসুবিধা কি!’

লাওলিন খুব খুশি হয়ে লাওফংকে ধন্যবাদ জানালেন। বিদায় নেবার সময় লাওফং তার হাতের মুরগীটা নতুন বন্ধুকে উপহার দিলেন। যদিও লাওলিন এই উপহার নিতে বেশ দ্বিধাবোধ করলেন, আপত্তিও করলেন, কিন্তু আন্তরিকতার এই নতুন নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না।

কিছুদিন পরে সপরিবারে লাওলিনের দালানে চলে এলেন লাওফং। যদিও আগের বাসাটার চাইতে এই বাসাটি ছোট তবুও একজন ভালো প্রতিবেশীর গুরুত্ব একজন আত্মীয়ের চেয়ে বেশি বলে মনে করলেন লাওফং।

পাশাপাশি বাড়ি হওয়ার পর লাওফং আরো ঘন ঘন লাওলিনের জন্য গ্রাম থেকে সস্তায় খরগোশ, মুরগী, চিংড়িমাছ, কাছিম, মিষ্টি আলু ইত্যাদি আনতে লাগলেন। কোন কোন জিনিস গ্রামের লোকেরা এমনিতেই লাওফংকে দিত বলে এগুলোর জন্য তিনি লাওলিনের কাছ থেকে দামও নিতেন না।

রোজ বাসে করে অনেক দূরের শহরতলীর স্কুলে যাওয়া-আসা করতে লাওফঙ্গের অসুবিধা হবার কথা শুনে লাওলিন শহরের মধ্যে কোন স্কুলে লাওফংকে বদলি করা হবে বলে নিজে থেকে কথা দিলান। এভাবেই দুই পরিবারের মাঝে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ট হয়ে উঠল।

একদিন লাওফং একটা রঙিন টেলিভিশন এনে সোজা লাওলিনের ঘরের শো-কেসের উপর রাখলেন। লাওলিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এ আপনি কি করছেন?’
লাওফং জবাবে বললো, ‘টেলিভিশনটা এখানে থাক।’

ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে লাওলিন বললেন, ‘আমি এখন এত টাকা যোগাড় করব কোথা থেকে?’

লাওফং অভিমান করে বললো, ‘আপনি এমন কথা বললে আমি এক্ষুনি টিভিটা তুলে নিয়ে যাবো। আমাদের দুই পরিবার কি ঠিক একই পরিবার নয়?’

লাওলিন বললেন, ‘সে তো ঠিক আছে কিন্তু এত দামি একটা জিনিস নিতে আমার লজ্জা করছে।’

লাওফং বললেন, ‘লজ্জার কি আছে, টেলিভিশন দেখতে চাইলে আমরা এ ঘরে এসে দেখবো। তাছাড়া আমার ফুফুর দেওর জাহাজে কাজ করে, সে কথা দিয়েছে, আমাকে একটা টিভি দেবেন। এক ঘরে দুটো টিভি দিয়ে আমি কি করবো বলুন।’

এ কথা শুনে লাওলিন টিভিটি রাখতে রাজি হলেন। দুদিন পরে লাওলিনের স্ত্রী টিভিটার জন্য সুন্দর একটা ঢাকনা তৈরি করলেন। লাওলিনও একটা অ্যান্টেনা কিনে আনলেন। এরপর লাওলিন মাঝে মাঝে অস্বস্তিবোধ করতে লাগলেন। তার মনে হতে লাগলো, তিনি লাওফঙ্গের বদলীর ব্যাপারে যে সাহায্য করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন, শহরতলী স্কুলে কাজ না করলে সস্তায় আর তিনি ভালো জিনিস পাবেন না ভেবে শহড়ে তাকে কাজ জুটিয়ে দেবার ব্যাপারে তিনি কোন চেষ্টাই করেন নি। তিনি বুঝতে পারলেন লাওফঙ্গের কাছ থেকে এত দামী উপহার পাবার পর তিনি যদি কিছু না করেন তাহলে তার মনের মাঝে অস্বস্তি থেকে যাবে। এসব ভেবে লাওলিন যথাসাধ্য চেষ্টা করে নিজের সংস্থার অধীনস্থ একটা মাধ্যমিক স্কুলে চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন। এতে দুই পরিবারের মাঝে ঘনিষ্ঠতা আরো বেরে গেল।

দু’তিন মাস পরে একদিন বাসায় ফিরে রান্নাঘরে একজন অপরিচিতা মহিলাকে দেখলেন। মহিলাটি তাকে জানালো যে তিনি লাওফঙ্গের সাথে ঘর অদল-বদল করেছেন। তিনি বললেন, ‘আমার বাতের ব্যথা আছে বলে আমি কোন উপর তলার ঘরে থাকতে চাইছিলাম। আর লাওফং সাইকেল করে স্কুলে যাতায়াত করে অথচ রোজ উপর তলায় সাইকেল উঠাতে-নামাতে ঝামেলা বলে তার দরকার ছিল একতলার কোন ঘর, তাই আমরা ঘর অদল-বদল করে নিয়েছি।’

একদিন লাওফং লাওলিনের ঘরে এসে বললেন, তার ফুফু তাকে একটা টিভি দিয়েছেন। তিনি লাওলিনের ঘরের টিভি সেটটা একটু নিয়ে যেতে চান, যাতে তিনি মিলিয়ে দেখতে পারেন তার ফুফুর দেয়া টিভিটায় কতটা পরিষ্কার ছবি আসছে।

লাওলিন নতুন টিভিটা দেখতে চাইলে লাওফং জানালো তার ঘরে এখন অতিথি রয়েছে। অতিথি চলে গেলে তিনি তাকে তার ওখানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাবেন। লাওলিন অপেক্ষা করে রইলেন। কিন্তু সেদিন আর লাওফং এলেন না। পরদিনও না। ক্রমে ক্রমে চারদিন কেটে গেল, লাওফঙ্গের আর দেখা নেই। তিনি লাওলিনের কাছ থেকে যে টিভিটা নিয়ে গেছেন তার কোন খবর নেই। লাওলিনের মনে সংশয় জাগলো। তিনি আর আমন্ত্রণের অপেক্ষা না করে লাওফঙ্গের বাসায় হাজির হলেন।

লাওফং তার ভূতপূর্ব প্রতিবেশীকে আপ্যায়ন করে বসালেন। দুজনে প্রথমে একথা সেকথা বলতে লাগলেন। টিভি সেটের প্রসঙ্গ কেউই তুললেন না। শেষে লাওলিন অধর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার নতুন টেলিভিশনটা কোথায়? আমাকে দেখাবেন না?’

লাওফং অমনি ঘরের কোণে রাখা টিভিটিকে দেখিয়ে বললেন, ‘ঐ তো আমার টেলিভিশন।’

লাওলিন পায়ে পায়ে কাছে গিয়ে দেখলেন সেটা তারই ঘর থেকে কয়েক দিন আগে নিয়ে আসা সেই আগের টিভিটিই। দেখে তিনি রেগে টং হয়ে গেলেন। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। শুধু কাষ্ঠ হাসি হেসে খসখসে গলায় বললেন, ‘ভালো, খুব ভালো।’

লাওফঙ্গের ঘরের বাইরে এসেই তিনি ঘরের দরজা তাক করে থু থু ফেলে, দাঁতে দাঁত ঘষে চাপাস্বরে বললেন, ‘দেখে নেবো, তুমি কত বড় ধরিবাজ।’

পরদিন থেকে লাওফঙ্গের বিরুদ্ধে গ্রাম থেকে সস্তায় আনা শাক-সব্জি আর মাছ-মুরগী বেশি দামে বিক্রি করার অভিযোগ আর লাওলিনের বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়ার পালটা অভিযোগ শোনা যেতে লাগলো।

এরপর তাদের মধ্যে রাস্তায় প্রথমবার দেখা হতেই দু’জনে দু’জনার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

দ্বিতীয়বার দেখা হতেই দু’জনেই প্রবল বিতৃষ্ণার সঙ্গে থু থু ফেললেন।

তৃতীয়বার দেখা হতে দু’জনেই বললেন, ‘ছি! ছি! দেখ তোর কি পরিণতি হয়।’

চতুর্থবার দেখা হতে একজন বললেন, ‘মুনাফাখোর! তোর পরিণাম বড় মারাত্মক হবে।’ অন্যজন বললেন, ‘লোভী হওয়ার পরিণাম কি ভালো হবে?’

পঞ্চমবার দেখা হতে এ ওকে বললেন, ‘বেহায়া!’ ও একে বললেন, ‘বদমাশ!’

ষষ্ঠবার দেখা হতেই দুজনের মধ্যে মারামারি বেঁধে গেল। একজনের শার্ট ছিড়ে গেল। অন্যজনের চশমা ভেঙ্গে গেল। মারামারি করতে করতেই দুজনে পুলিশের কাছে গেলেন। ঝগড়া মারামারির কারণ যখন তাদের কাছে জিজ্ঞেস করা হলো, দুজনেই তখন হঠাৎ চুপ মেরে গেলেন।

সবাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগলো, এমন দুই আদর্শ প্রতিবেশীর মধ্যে এত বিদ্বেষের সৃষ্টি হল কিভাবে!

No comments:

© 2007-2023 IQBAL AHSAN