গোয়েন্দা - iqbal's blog

গোয়েন্দা

Share This

আহমেদ জালাল শেলী

ঘরে এসে পড়ার টেবিলে বসেছি কি বসিনি অমনি শুনলাম মৌটুসির গগণ বিদারী চিৎকার, 'ভাইয়ারে ধর ধর নিয়ে গেল রে।' চিৎকার শুনে হুড়মুড় করে ভিতরের বারান্দায় এসে দেখি এই মাত্র বাজার করে আনা থলে থেকে একটা একটা করে জিনিস বের করছিল মৌটুসি আর সুর করে তা উচ্চারণ করছিল, যেইনা তিন পোয়া ওজনের রুই মাছটা বের করেছে ওমনি কোত্থেকে এক পাজী বিড়াল খপ করে নিয়ে প্রাণপনে ছুটছে বাইরের দরজার দিকে। আর মৌটুসি ভয়ে জড়সড় হয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে হাতে একটা সজনে নিয়ে তর্জন গর্জন করছে। সেই সময় বাইরে থেকে দরজা দিয়ে বাসায় ঢুকছিল অমি। গোলমাল শুনে তো বেচারা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো দরজার সামনেই। বিড়ালটাও তার সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে গেল, বের হবার রাস্তা নেই। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে অমির মাথার উপর দিয়ে এক লাফ দিয়ে হাওয়া। 'ওরে বাবারে' বলে এক দৌরে বারান্দায় এসে উঠলো অমি। ঘটনাটা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে গেল। মৌটুসি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো অমির উপরে, 'একটা বেড়াল ধরতে পারলি না, বীরপুরুষ কোথাকার।' বারান্দায় দাঁড়িয়ে বোকার হাসি হাসলো অমি। গোলমাল শুনে মা ভেজা কাপড়ে বেরিয়ে এলেন বাথরুম থেকে। 'কি হয়েছে?' 'বিড়ালে মাছ নিয়ে গেছে' আমি উত্তর দিলাম। 'না, মানে, ইয়ে...' মিনমিন করে করে কি যেন বলতে চাইল মৌটুসি। ধমকে তাকে থামিয়ে দিলেন মা, 'যা পার না, তাই নিয়ে বাড়াবাড়ি কর বেশী বেয়াদব মেয়ে' বলেই আবার বাথরুমে ঢুকলেন।

এই চরিত্র দুটির পরিচয় না দিলেই নয়, মৌটুসি আমার ছোট বোন সবে সিক্সে উঠেছে আর অমি আমার ছোট ভাই ফাইভে পড়ে। কিন্তু তা হলে কি হবে, এই বয়সেই বাচ্চাদের যত গোয়েন্দা গল্প উপন্যাস বেরিয়েছে সব তার মুখস্থ। পাড়ার সব সমবয়সী ছেলেমেয়েদের নিয়ে রবিনহুড, টম সয়্যার খেলে। অমি টম সয়্যার হবার স্বপ্ন দেখে। শুধু স্বপ্ন নয়; এইতো গত গ্রীষ্মে গ্রামে মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে মামার প্রিয় চীনে মুরগীটা কোন জঙ্গলে ডিম পাড়ে তা দুদিনেই গোয়েন্দাগিরী করে বের করে ফেলেছিল। সেই থেকে আমরাও তাকে মাঝে মাঝে টম সয়্যার বলি।

মার গাল শুনে মৌটুসি পেয়ারা গাছের নিচে গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে অমির দিকে আগুন দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো, যেন সব দোষ অমিরই। কারণ অমি বিড়ালটা ধরতে পারলে মনের সুখে তার পিঠে সজনেটা ভেঙ্গে কিছু শোধ তোলা যেত। অমি বোধ হয় গোয়েন্দাগিরীর সুযোগটা ছারতে চাইলো না। টম সয়্যারের মতই হাটতে হাটতে বোনের সামনে গিয়ে বললো, 'কুছ পড়োয়া নেইরে মৌপা বিড়ালটা আমি আজই ধরে এনে দেব।' 'পারবি' চোখ জোড়া উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মৌটুসির, 'আমি কিন্তু মারতে পারব না, তুইই না হয় আমার হয়ে দিয়ে দিস গোটা কতক ঘা।' 'সে দেবক্ষণ, আগে তুই আমার প্রশ্নের উত্তর দে' ডিটেক্টিভ চালে প্রশ্ন শুরু করলো অমি।

'কি মাছ ছিল ওটা?'

'রুই'

'কোন অংশটা নিয়ে গেছে?'

'গোটাটাই তো...'

হটাৎ গম্ভীর হয়ে গেল অমি,

'কি করছিল?'

'কে!'

'বিড়ালটা'

'মিউ মিউ মানে ঘুর ঘুর করছিল অনেকক্ষণ ধরে আশে পাশে আর মিউ...'

তাকে থামিয়ে দিল অমি, 'বিড়ালটা কার জানিস?'

'বিন্দুদের' উত্তর এলো।

'হুলো না মেনি?'

'তার মানে?' অবাক হল মৌটুসি।

ধমকে উঠলো অমি, 'গ্রামারে পড়নি হুলো বিড়াল, মেনি বিড়াল, মানে ছেলে না মেয়ে বিড়াল।'

কিছুক্ষণ চিন্তা করলো মৌটুসি, 'মেয়ে বিড়াল মনে হয়।'

ততক্ষণে সরে গেছে অমি সেখান থেকে একটা কাঠি দিয়ে দেয়ালটা মাপছে মনযোগ দিয়ে। 'নারে মৌপা ওটা হুলো ছিল।'

সাবান দিয়ে হাত ধুচ্ছিল মৌটুসি। হাত নাড়ানো বন্ধ হয়ে গেল, 'কি করে বুঝলি?'

'আরে মেয়েদের অত উঁচুতে লাফ দিতে দেখেছিস?' বিজ্ঞের মত উত্তর দেয় অমি। মৌটুসি আপত্তি জানায়, 'ওটার তো গোঁফ ছিল না, হুলো হবে কেমন করে?'

ক্ষেপে গেল অমি, 'কেন, গোঁফ থাকতেই হবে ছেলেদের, কৈ আমার আছে? তাছাড়া জানিস মেয়েদেরও গোঁফ হয়, দেখিসনি মন্টিদের ছাগলটা, ইয়া ইয়া দাড়ি।'

হয়তো আরও কিছু বলতো কিন্তু মা পেছন থেকে এসে তার কানটাকে আচ্ছা করে মলে দিলেন। আশ্চর্য কাঁদলো না একটুও গোয়েন্দা প্রবর, অন্যদিন হলে দেখতে হতনা ততক্ষণ। ছোট ভায়ের অবস্থা দেখে মৌটুসি ভোঁ দৌড় বিন্দুদের বাসার দিকে। খবর পেয়ে দৌড়ে এল বিন্দু। বাসায় ঢুকতেই অমি তাকে আটকালো। 'তোদের বাসায় কতদিন ধরে আছে রে বিরালটা?'

মিউমিউ করে বলল বিন্দু, 'দুই মাস, কাল পালিয়েছে, পাচ্ছিনা খুঁজে, একটু খুঁজে দেনা ভাই, আচ্ছা করে ধমকে দেব পাজিটাকে।'

'হু' করে সেখান থেকে সরে এলো ক্ষুদে গোয়েন্দা অমি।

দুপুরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর। বাসায় সবাই ঘুমাচ্ছে। শুধু পেয়ারা তলা থেকে মৌটুসিদের পুতুল খেলার হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে। সে খেলায় যোগ না দিয়ে বারান্দার এক কোণে বসে একটা মাছের কাঁটা খুব মনোযোগ দেখছে অমি আমার ম্যাগনিফ্লাইং গ্লাসটা দিয়ে। ওর পেছনে গিয়ে দারালাম ও কিছু টের পেল না। 'কোথায় পেলি কাঁটাটা?'

চমকে উঠেই আমাকে দেখে লেন্সটা লুকালো। বোকার হাসি হাসলো, 'ঐ বাগানে।'

'কি দেখলি?'

'আমাদের মাছটার, এই দেখ না রুই রুই গন্ধ লেগে আছে।' আমাকে হাসতে দেখে লজ্জায় পালিয়ে গেল।

বিকেলে প্রতিদিনের মত সেজে গুজে খেলতে গেল দু' ভাইবোন,সামনের মাঠে। যথারীতি সন্ধ্যেয় মৌটুসি ফিরে এলো কিন্তু অমির কোন পাত্তা নেই।

'অমিতো আজ আমাদের সঙ্গে মাঠে খেলেনি, ভাবলাম বুঝি বাসায় ফিরে এসেছে।' মৌটুসি কাঁদ কাঁদ গলায় বলল।

মাকে দেখে মনে হল এখুনিই কেঁদে ফেলবেন। খোকন আর পার্থ সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল খুজতে। আমি আর আব্বু বের হবো হবো করছি এমন সময় অমি এসে হাজির। তার পরনে ছিল সাদা সার্ট আর প্যান্ট কিন্তু এখন দেখছি কালো, হাতে একটা বিড়াল, রীতিমত জ্যান্ত। মা দৌড়ে কাছে গিয়ে চেচিঁয়ে উঠলেন, 'হতভাগা কোথায় পড়ে গিয়েছিলি?'

আব্বুকে সামনে দেখে কুঁকড়ে গেলো, 'ঐ বড় ড্রেনে।'

'ওখানে কেন গিয়েছিলি?' হুংকার ছাড়েন আব্বু।

ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল অমি, 'এই বিড়ালটা ধরতে।'

মা হো হো করে হেসে দিলেন। মোটুসি ততক্ষণে একটা দড়ি পরিয়ে দিয়েছে বিড়ালটার গলায়। পরিবেশ হালকা দেখে একগালা হেসে বললো অমি, 'দারুণ কষ্ট হয়েছে এটাকে ধরতে, একঘন্টা এটার পেছন পেছন ঘুরে আধ ঘন্টা ঝোপের ভেতরে লুকিয়ে যেই ধরতে গেছি অমনি দু'জনে বড় ড্রেনে ঝপাৎ।'

পার্থ নাকে হাত দিয়ে ছ্যা ছ্যা করে উঠল। এদিকে মৌটুসি একটা লাঠি দিয়ে শাসাচ্ছে বিড়ালটাকে, যেই একটা বাড়ি দিতে গেছে অমনি বিড়ালটা দড়িসহ দে দৌড়। বিড়ালটাকে ধরতে গিয়ে অমি একটা লাফ মারল কিন্তু হুড়মুড়িয়ে পড়ল আব্বুর গায়ের উপর। অমির গায়ের ড্রেনের আলকাতরার মত কালো কাদায় তিনি একাকার। এই এই করতে করতে তিনি পড়লেন পাশে মার গায়ের উপর, তিনি ততক্ষণে চিৎপটাং। নিমিষেই ঘটে গেলো ঘটনাটা।

ব্যাপার দেখে সটকে পড়ার আয়োজন করছিল অমি কিন্তু তার আগেই দরজায় দেখা গেল পাশের বাসার পিকলুকে, সঙ্গে তার গম্ভীর মুখো বড় ভাই, হাতে অমির ধরা বিড়ালসহ দড়িটা। পিকলু কাঁদতে কাঁদতে অমিকে দেখিয়ে দিল, 'এই অমিই আমার বিড়াল ধরেছিল।'

'তোমার বিড়াল পিকলু!' আমরা অবাক।

পিকলুর ভাই হেসে বললেন, 'আর বলবেন না, বিকেলে বিড়ালটা নিয়ে মাঠে খেলতে গেছে, তারপর দেখি কাঁদতে কাঁদতে বাসায় আসছে। অমি নাকি তার বিড়াল ধরে নিয়ে গেছে।'

এমন সময় বিন্দু দৌড়াতে দৌড়াতে এলো মৌ, 'অমি আমার বিড়ালটা পাওয়া গেছে একা একাই ফিরে এসেছে রে।'

মৌটুসি হতভম্ব, 'এটা তোর বিড়াল না?' হাত দিয়ে দেখালো পিকলুর হাতের বিড়ালটার দিকে।

'না না আমারটাতো বাসায় বেঁধে রেখে এলাম।' বিন্দু অবাক হয়।

অমি একবারে চুপসে গেছে। সমস্ত ঘটনা শুনে পিকলুর ভাই থেকে সবাই সেকি হাসি। হটাৎ অমি পিকলুর ভাইকে জিজ্ঞেস করল, 'আপনার বিড়ালটা হুলো না মেনি?'

'কেন মেনি বিড়াল!' অবাক হন পিকলুর ভাই।

'আর তোমারটা বিন্দু?'

'বোধ হয় মেয়ে বিড়াল।'

নিরাশ হলো অমি, 'তাহলে, কোন হুলো বিড়ালের কাজ এটা, মেনি বিড়ালের সাধ্য কি দেয়াল ডিঙ্গাবার।' বলেই পকেট থেকে কাগজে মোড়ানো একটা মাছের অর্ধেকটা বের করে দিল মৌটুসিকে। 'সামনের জঙ্গলে পেয়েছি, খেতে পারেনি।' বলেই গটগট করে বাথরুমে ঢুকে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করল ক্ষুদে গোয়েন্দা অমিত হাসান অমি।

No comments:

© 2007-2023 IQBAL AHSAN