Conspiracy Theory বা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিশ্বাস করে যারা তাদের সবচেয়ে বড় ভান্ডার হচ্ছে আমেরিকান সরকারের ‘এরিয়া ৫১’। ফ্লাইং সসার, এলিয়েন, মিথ্যা চাঁদে অবতরণ এ সকল বিশ্বাসের মূল কেন্দ্র বলতে গেলে এই ‘এরিয়া ৫১’ কে নিয়েই।
এ সকল বিশ্বাসকে মিথ্যা প্রমাণ করবার জন্য আমেরিকার সরকার কোন ধরণের প্রচেষ্টা করে নি। এমন কি তারা এ ধরণের কোন মিলিটারি স্থাপনা রয়েছে তাও স্বীকার করে নি।
ধরে নেয়া হয় নেভাডার দক্ষিণে এবং লাস ভেগাসের উত্তর-উত্তর পশ্চিমাংশ থেকে ৮৩মাইল(১৩৩কিমি) দূরে অবস্থিত। এখানে মূলত পরীক্ষামূলক বিমান ও অস্ত্র তৈরি, উন্নতিসাধন এবং পরীক্ষা করা হয়।
‘এরিয়া ৫১’ এর প্রয়োজন পরে যখন রাশিয়া এবং আমেরিকার মধ্যে চলছিল কোল্ড ওয়ার (স্নায়ু যুদ্ধ)। তখন সকলের চোখ এড়িয়ে আমেরিকা কিভাবে আরো উন্নত মানের উড়োজাহাজ প্রস্তুত করতে পারে তার গবেষণা এবং পরীক্ষা চলতো এ অঞ্চলে।
জায়গাটি সর্ব সাধারণের প্রবেশ নিষেধ হলেও ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফি’ এ অঞ্চলের কিছু ছবি প্রকাশ করছে। এই ছবিগুলোতে আমরা ১৯৬৩ সালে ঘটা একটা স্পাই বিমান দুর্ঘটনার চিত্র এবং এ ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা।
একটি টাইটানিয়াম এ-১২ স্পাই বিমানের প্রটোটাইপ রাডার পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে।
১৯৫০ এবং ৬০সালে ‘অক্সকার্ট’ নামে একটা প্রকল্পের মাধ্যমে তৈরি হয় A-12 বিমান। এই বিমানটি ছিল U-2 নামক আরেকটি স্পাই বিমানের উত্তর সূরী এবং বর্তমান SR-71 BLACKBIRD স্পাই বিমানের পূর্বাভাস স্বরূপ।
বিমানটি রাডারের হাতে চিহ্নিত না হয়ে ঘন্টায় ২২০০ মাইল(৩৫৪০কিমি) বেগে উড়বার ক্ষমতা ছিল। ৯০০০০হাজার ফুট উপর থেকে ক্যামেরার মাধ্যমে মাটিতে থাকা ১ফুট দৈঘ্য সমান বস্তুর ছবি তোলার ক্ষমতা ছিল এই বিমানের।
কিন্তু আমেরিকার সরকার একে আরো উন্নত করতে গিয়ে এক বিশাল দুর্ঘটনার সৃষ্টি করে। দ্রুত হস্তক্ষেপের কারণে সরকার ব্যাপারটি লুকিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়।
এই ধ্বংসাবশেষের ছবি সি আই এ এতদিন পর প্রকাশ করেছে।
এ-১২ বিমানের ধ্বংসাবশেষ- দুইটা ইঞ্জিন, ছিন্নভিন্ন পেছনের ফিউজলাজ
পরীক্ষামূলক বৈমানিক কেন কলিন্স (এরিয়া-৫১ এর ছদ্মনাম কেন কলমার) এর ক্ষেত্রে সব কিছু উলটাপালটা হয়ে পড়ে যখন তিনি খুব লো অ্যাল্টিচ্যুড এ বিমানের সাবসনিক ইঞ্জিনটিকে পরীক্ষা করতে শুরু করেন। ‘২৫০০০ ফিট উচ্চতায় হঠাৎ বিমানের মাথা উপরের দিকে উঠতে থাকে তারপর উলটে যায় এবং অনুভূমিক ঘুরতে শুরু করেন’ স্মৃতি চারণে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে বলেন কলিন্স।
‘এ ধরণের পতনের হাত থেকে উড়োজাহাজকে রক্ষা করবার উপায় নেই। আর তাই আমি বের হবার সিদ্ধান্ত নেই।’
আকাশ থেকে তোলা ছবিতে দেখা যাচ্ছে রেসপন্স টিমকে
কেন যখন প্যারাসুটের মাধ্যমে মাটিতে নামতে সামর্থ হন তখন তিনি বিস্মিত হয়ে দেখেন তিনজন সাধারণ জনগন তার জন্য পিকআপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরা কলিনকে ধ্বংশাবশেষের কাছে নিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু কলিন তাদেরকে নিয়ে উলটা দিকে রওনা দিলান এ জানিয়ে যে বিমানে পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে – এ ধরণের গল্প আগে থেকে তৈরি করে রাখা হয়েছিল।
সরকারি কর্মকর্তারা একটু পরে এসে জায়গাটি পরিস্কার এবং ধামাচাপা দেবার কাজ শুরু করে। পরের দিন সকালের আগেই সমস্ত ধ্বংশাবশেষ এরিয়া ৫১ তে নিয়ে যাওয়া হয় ট্রাকের মাধ্যমে। পরবর্তী অর্ধশতকের মধ্যে কেউ এই জায়গাটিতে আর আসেনি।
এ-১২ এর সমস্ত প্রমাণ ভারী যন্ত্র ব্যবহার করে সরানো হচ্ছে
অ্যারোস্পেস ঐতিহাসিক পিটার মারলিনের মতে ধ্বংশাবশেষের কিছু অংশ ডায়নামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেবার চিন্তা ভাবনা ছিল জাতে কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে তা চিহ্নিত করা সম্ভব না হয়।
আজ এ ঘটনাকে লুকিয়ে রেখে আর কোন সুবিধা পাওয়া যাবে না বিধায় ‘CIA’ এ ছবিগুলো প্রকাশ করেছে বলে মনে করেন ঐতিহাসিক ডেভিড রবার্জ। ‘২০০৭ সালে অক্সকার্ট প্রকল্প সংক্রান্ত অনেক তথ্য প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে কিভাবে এয়ার ফোর্সের কাছ থেকে নয়টার মধ্যে থেকে একটা এ-১২ বিমান তারা অধিগ্রহন করেছে’ যা এখন সি আই এর প্রধান কার্যালয়ে শোভা পাচ্ছে।
ক্রেনের মাধ্যমে সমতল ট্রাকে এ-১২ এর ধ্বংশাবশেষ তোলা হচ্ছে
যদিও সি আই এ ঘটনার কিছু ছবি প্রকাশ করেছে তথাপি এ ধামাচাপার ব্যাপারে কারা জড়িত ছিল কিম্বা কিভাবে এটি সম্পন্ন হল সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানায় নি।
অ্যারোস্পেস ঐতিহাসিক পিটার মারলিন, দুর্ঘটনার জায়গাটি কয়েকবার প্রদর্শণ করেছেন, তার মতে ‘এ-১২ এর ফিউজলাজ এবং পাখা ব্লো-টর্চ দিয়ে কেটে আলাদা করে ট্রাকে তোলা হয়, সাথে তোলা হয় লেজ এবং আর যে সকল বড় বড় যন্ত্রাংশ ছিল সেগুলোকে। পড়ে থাকা ছোট ছোট যন্ত্রাংশগুলোকে বাক্সে ভরা হয়েছিল।’
পরিস্কার করবার আগে যাতে বিমান থেকে দেখা না যায় তাই
তারপুলিন দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে
যখন দুর্ঘটনাটা ঘটে তখন অক্সকার্ট প্রকল্পটি খুব গোপনীয় প্রকল্প ছিল, এটি প্রকাশ হয়ে পরলে আমেরিকার শত্রুরা বিকল্প বা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিয়ে ফেলত। আর তাই আমেরিকার সরকার এ ঘটনাটিকে ধামাচাপা দিয়েছে।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টাইটানিয়ামের টুকরো
টাইটানিয়ামের টুকরা আজো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারিদিকে। পিটার মারলিন এলাকা ঘুরে এ ধরণের অনেক টুকরা দেখতে পেয়েছেন। তিনি এখানে বিমানের পাখা এবং ককপিটের কিছু অংশ পেয়েছেন যাতে এখনো ‘স্কাঙ্ক অয়ার্ক্স’ এর ছাপ দেয়া আছে। ‘স্কাঙ্ক অয়ার্ক্স ছিল প্রতিরক্ষা বিভাগের একটা ভাগ যেখানে লকহিড কাজ করত।
ডামি
এখানে এ-১২ এর একটা ডামি দেখা যাচ্ছে। রাশিয়ান স্পাই স্যাটেলাইট থেকে রক্ষা করবার জন্য এরিয়া ৫১ এ যারা কাজ করত তারা ডামিটা তৈরি করে। এছাড়া এর মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখত ডিজাইনটা কতটা রাডারে ধরা পরে বা না পরে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে এ বিমানটি বানাতে যে ধাতু ব্যবহার করা হয়েছে তার উৎপত্তি রাশিয়াতে। বিমান তৈরিতে ৯৩ ভাগ টাইটানিয়াম ধাতু ব্যবহার করা হয়েছিল। আর এ ধাতু গোপনে সংগ্রহ করা হয় রাশিয়া থেকে।
১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ব্ল্যাকবার্ড স্পাই বিমান হিসেবে কাজ করে। এর বুৎপত্তিও ঘটেছে এরিয়া ৫১ এ। এ-১২ এর চাইতে এ বিমানটি আকারে বড়, আরো বেশি তেল বহন করতে পারে এবং ধারগুলো তীক্ষ্ণ হবার কারণে আরো বেশি স্থিতিশীল এবং নিজেকে লুকাতে পারে। এ বিমানে লস অ্যাঞ্জেলস থেকে ওয়াশিংটন ডিসি যেতে লাগে মাত্র ৬৪মিনিট।
এরিয়া ৫১ আজও গবেষণা করে যাচ্ছে আরো আধুনিক কোন সমরাস্ত্র তৈরির সংকল্প নিয়ে। কিন্তু আবার কয়েক যুগ না গেলে সে সম্পর্কে আমরা কিছু জানতে পারবো না। যদিও এ ছবিগুলো প্রকাশ করা হয়েছে কিন্তু তবুও রবার্জকে এর অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ‘দুঃখিত, আমি এ ধরণের কিছু জানি না।’
সুত্রঃ
২. উইকি
৩.Photograph from CIA via Pangloss Films
No comments:
Post a Comment